তামাকপণ্যের দাম বাড়িয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণের পরামর্শ

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়িয়ে সরকার বছরে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারে বলে মনে করেন তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।
এমন প্রেক্ষাপটে তামাকজাত পণ্যগুলোর কার্যকর দাম বাড়িয়ে সরকার আইএমএফের ঋণ শর্তের লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার (১০ মে) ঢাকায় ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত “তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ : বাজেট ২০২৩-২৪” শীর্ষক আলোচনা সভায় তারা এ দাবি জানান।
তামাকবিরোধী গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ও অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) যৌথভাবে এ কর্মশালার আয়োজন করে।
কর্মশালায় মূল উপস্থাপনা তুলে ধরেন প্রজ্ঞার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক প্রকল্প প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর, সিটিএফকে বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আব্দুস সালাম, আত্মার কো-কনভেনর মিজান চৌধুরী ও প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।
হাসান শাহরিয়ার বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, তামাক ব্যবহারের কারণে ২০১৮ সালে ১ লাখ ৬১ হাজারেরও অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।
আরেক জরিপ বলছে, তামাকের প্রভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেন বছরে আরও প্রায় ৪ লাখ মানুষ (২০০৪)। আর ধূমপান না করেও ১৯ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে, ৩৮ শতাংশ গণপরিবহনে ও ৩৭ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন (২০১৭)।
এমনকি ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পাওয়া গেছে (২০১৭)।
তিনি বলেন, তামাকজাত পণ্যের কার্যকর করারোপের মাধ্যমে দাম বাড়ানো হলে ৪ লাখ ৮৮ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ লাখ ৯২ হাজার তরুণ জনগোষ্ঠীর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে।
মূল উপস্থাপনায় হাসান শাহরিয়ার বলেন, সম্প্রতি আইএমএফ ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশকে রাজস্ব খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। শর্ত অনুযায়ী, আগামী অর্থবছর থেকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অন্তত দশমিক ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর রাজস্ব আদায় করতে হবে।
অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই কর আদায় বাড়াতে হবে কমপক্ষে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এক্ষেত্রে সরকার চাইলে তামাকের মত স্বাস্থ্য হানিকর পণ্যের দাম কার্যকরভাবে বাড়িয়ে এই লক্ষ্যমাত্রার উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ করা সম্ভব।
এমনকি, বর্ধিত রাজস্ব একইসাথে অর্থনীতিতে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে।
এসময় তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সুনির্দিষ্ট করারোপের মাধ্যমে সব ধরণের তামাকপণ্য বিশেষ করে কমদামি সিগারেটের দাম বাড়িয়ে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
একইসাথে খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে বলে জানান বক্তারা।
বক্তারা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনীটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য ক্যাবিনেট ডিভিশনে পাঠানো হয়েছে। এটি চূড়ান্ত করতে যত দেরি হবে তামাকজনিত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি ততই বাড়বে।
কর্মশালায় জানানো হয়, আইএমএফ ঋণের বিপরীতে যে অতিরিক্ত কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ তামাকপণ্যের কর ও দাম কার্যকরভাবে বাড়িয়ে পূরণ করা সম্ভব।
বর্তমানে সিগারেট ব্যবহারকারীদের প্রায় ৭৫ শতাংশই কমদামি সিগারেটের ভোক্তা এবং এই স্তরে সম্পূরক শুল্কহার খুবই কম, মাত্র ৫৭ শতাংশ।
কর্মশালায় নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করে ৩৫.৭৫ টাকা অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়।
মধ্যম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ, উচ্চ স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১১১ টাকা থেকে ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।
একইসাথে বিড়ি, গুল ও জর্দার দাম বাড়িয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় কর্মশালায়।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্যে এবিএম জুবায়ের বলেন, ভোক্তারা দিন দিন সস্তা সিগারেটের দিকে ঝুঁকছেন। হয়তো শুধু দাম বাড়িয়েই ধূমপান কমানো যাবে না।
কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে দাম বাড়ানোর কথা আমরা বলি। একটি সিগারেটের প্যাকেটের দাম যদি ৩০০ টাকা হয়, তাহলে কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী সেটি কিনে খেতে পারবে না।
তিনি বলেন, যারা এখন ধূমপান করছেন, তারা হয়তো সহজেই ছেড়ে দেবেন না, তবে আমরা মনে করি দাম বাড়লে অবশ্যই সিগারেট খাওয়ার সংখ্যাটা কমে যাবে।
যে ব্যক্তি দিনে আটটি সিগারেট খান, তারা হয়তো ৫ থেকে ৬টি খাবেন। এভাবেই হতে পারে অনেকেই ছেড়েও দিতে পারে। তবে আমাদেরকে এখনই ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে ভাবতে হবে।
কর বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, কর বাড়িয়ে যদি মূল্যটা বাড়ানো হয়, তাহলে সরকার লাভবান হবে। আর যদি কোম্পানি কর্তৃক দাম বাড়ানো হয়, তাহলে লাভবান হবে মালিকপক্ষ।