বাঘার শাহী মসজিদের টেরাকোটায় আমের চিত্রাঙ্কন

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বাঘা : রাজা নেই শাহি নেই, রাজশাহী নাম,হাতি ঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম। রাজশাহীর ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম উৎপন্ন হয় বাঘায়। আমের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত বাঘার আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে ।
সবকিছুকে ছাড়িয়ে যেমন আছে নামের বাহার, তেমনি রয়েছে ভিন্ন সব স্বাদ-বর্ণ-ঘ্রাণ। যেমন-বৃন্দাবনী আম রঙে যেমন,খেতেও সুস্বাদু। রসে ভরা, আঁশ নেই, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়-ক্ষিরের জালি,সন্দেশি,রমু খিরসা, গোপাললাড়ু,নুরু মিঞার গুটিসহ পরিচয়হীন অনেক আম রয়েছে। এইসব আম এলাকায় খুব কম। সব মিলে প্রায় দেড়শ জাতের বাহারি নামের আম উৎপাদন হয় এই উপজেলায়। অনেক আমের নামও শোনেননি উপজেলার বাইরের মানুষ।
সূর্যডিম বা মিয়াজাকি হলো জাপানিজ আম। বিশ্ববাজারে এটি ‘রেড ম্যাংগো’ নামে পরিচিত। ‘কিং অব চাকাপাত’। থাইল্যান্ডের একটি স্থানের নামে আমের এমন নামকরণ। কলার মতো দেখতে, তাই নাম ‘ম্যাংগো ব্যানানা’। হাতির দুই পায়ের মতো ছড়িয়ে পড়া ‘ম্যাট্রোস তোতা’, আপেলসদৃশ ‘আপেল ম্যাংগো’। এসব আমও এখন চাষ হচ্ছে বাঘা উপজেলায়। জাতীয়ভাবে পরিচিত আমের মধ্যে রয়েছে-ন্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি, ক্ষিরসাপাত, হিমসাগর, মোহনভোগ, লক্ষণভোগ (লখনা), আশ্বিনা, আড়াজাম, মিসরিভোগ, চৌষা, কাঁচামিঠা ইত্যাদি।
আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন জাতের আরো বাহারি নামের আমের পরিচিতি পাওয়া যায়। বাউসা মিঞাপাড়া গ্রামের মাসুদ রানার বাগানের কেজি ওজনের বালিশগুটি, বাজুবাঘা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের রমু খেরসাসহ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে উৎপাদিত- জগৎমোহিনী, বারি আম-৪, বারি আম-১১, আম্রপালি, মল্লিকা, হাড়িভাঙ্গা, বোম্বাই, কার্টিমন (বারোমাসি),গৌড়মতি ছাড়াও আরো কিছু মজার মজার নামের আম আছে।
যেমন-বৌভূলানো, ছাতু ভিজালী, ঝিনুক, কাঁকড়ি, পাগাড়ে, ইঁদুরচাটা, বাবুইঝুকি, মধু চুষকা, অনামিকা, কৈদি, ধইসি , গোল্লা, জালিবাস, ঠুটি, ভুরই, খালসি, জামাইভোগ, নাজির ভোগ, দুধ সাগর, আনার কলি, আনারসী, দুধভরা, দুধ কোমর, বাতাসী, ফনিয়া, জহুরা, লাখে এক, খাজা গুটি, চিনিখোরা, চুঙ্গাভোগ, বিবি, চাপড়া, ডুকসা, হাতিম, কৃষাণভোগ, কাদুমা, বেলি, দুধসর, চেংসাই, ডকমাই, ভাদরী, নাকাবাসী, সুমাসি, দিংলি, হাতিঝোলা, কোদালকাটি, সিন্দুরটোকা, জাওনি, স্বপ্নবিভর, বৈশাখী, কালুয়া, বিশ্বনাথ, বাঘাশাহি, বঙ্গবাসী, আষাঢ়ি, বাতাসী, ধমিয়া, মোহনঠাকুর, মেথা, ফকিন্নী, মিছরিছানা, সালাম ভোগ, মধু খালসি, পেঁপে গুটি, পেপসি গুটি, সুগন্ধি গুটি, আবদুল¬াহ ফজলি, কালিভোগ, মধুমতী, চরুষা, চমন বাহার, সেঁদুরি, কালিভোগ, নাকফজলি, সুরমা ফজলি, জাইন্ট খিরসাপাত, চোষা, নন্দাফ্রাম, বড়গুটি, ছোটগুটি, বোম্বাই, ইত্যাদি।
অতীতকালের ত্রিফলা, কিষান ভোগ, সূর্যপরি, চালকি, কালিভোগ, রাণী পছন্দ, কালুয়া, ধলুয়া, রাজভোগ, বগা ইত্যাদি জাতের আম এখন বিলুপ্ত প্রায় । এসবের মাঝে বিষাদের কিছু আমের নামও শোনা যায়। যেমন- খাটাশি,বিলি পাদুড়ি ইত্যাদি। দেখতে অত্যন্ত বড় হলেও স্বাদে টক হাওয়াই এটাকে খাটাশি ও বিলি পাদুড়ি বলা হয়।
নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে গাছ লাগানোর পর অনেকে নিজেদের নামে আমের নামকরণ করতেন। বাজুবাঘার আব্দুল হালিম জানান, তার দাদার বাবা সৈয়দ হোসেন মিঞার লাগানো বিভিন্ন জাতের আমের নাম শুনেছেন। কলমি লতা জাতের গাছটি লতার মতো বিস্তৃত হওয়ায় এটাকে কলমি লতা বলা হয়। দেলসাদের লাগানো গাছটির আম দেলসাদ নামেই পরিচিত। সিঁদুরি নামের আমটি মকছেদ মিঞার সিঁদুরি নামে পরিচিত।
শাহদৌলা সরকারি কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আব্দুল হানিফ মিয়া বলেন, হেরিটেজ রাজশাহী থেকে প্রকাশিত মাহবুব সিদ্দিকীর আম বিষয়ক একটি বইয়ে উল্লেখ আছে, ব্রিটিশ ভারতে মালদহ জেলার কালেক্টর রাজভেনশ (র্যাভেন) ‘ফজলি’ নামকরণ করেন। এর আগে ফজলি আম ‘ফকিরভোগ’ বলে পরিচিত ছিল।
এই জাতটি ফজলি বিবি নামে এক বৃদ্ধার বাড়ি থেকে প্রথম সংগৃহীত হয়েছিল। তিনি বাস করতেন বাংলার স্বাধীন সুলতানদের ধ্বংসপ্রাপ্ত গৌড়ের একটি প্রাচীন কুঠিতে। তার বাড়ির আঙিনায় ছিল একটি পুরনো আমগাছ। তবে এটি কোন জাতের, সে বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না তার। ফজলি বিবি গাছটির খুব যত্ন নিতেন। গাছটিতে প্রচুর আম ধরত। আমগুলো যেমন আকারে বড়, তেমনি সুস্বাদু। সেখানকার নির্জনবাসী ফকির-সন্ন্যাসীদের তিনি এই আম দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। সে জন্য ফজলি বিবি এই আমের নাম দিয়েছিলেন ‘ফকির’ ভোগ।
কথিত আছে, ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে মালদহের তৎকালীন কালেক্টর রাজভেনশ (র্যাভেন) ঘোড়ার গাড়ি চেপে গৌড় যাচ্ছিলেন। অবকাশ যাপনের জন্য ফজলি বিবির কুঠির কাছে শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেই খবর পেয়ে ফজলি বিবি ‘ফকিরভোগ আম’ নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। ব্রিটিশ সাহেব সেই আম খেয়ে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। কালেক্টর সাহেব ইংরেজিতে তাকে আমের নাম জিজ্ঞেস করেন। বুঝতে না পেরে ওই মহিলা তার নিজের নাম বলে বসেন। সেই থেকে ওই আমের নাম হয়ে যায় ফজলি। তখন থেকে ‘ফজলি’ নাম মানুষের মুখে মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের,বাঘা উপজেলা কার্যালয়ের কর্মকতা, কৃষিবিদ শফিউল্লাহ্ সুলতান বলেন, ১৫২৩-১৫২৪ খিস্টাব্দে (হিজরি-৯৩০)সুলতানি আমলে নির্মিত রাজশাহীর বাঘা শাহী মসজিদের টেরাকোটায় আমের চিত্রাঙ্কন রয়েছে। তা দেখে বোঝা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই রাজশাহীর বাঘায় আমের খ্যাতি ছিল।
তিনি জানান,বাণিজ্যিক জাতের আমের মধ্যে নামকরণের কিছু ইতিহাস লোকমুখে প্রচলিত আছে। যেমনÑ বিহারে এক ল্যাংড়া ফকিরের বাড়ি থেকে উন্নতমানের যে আম গাছের চারা সংগ্রহ করা হয়েছিল। তাই ল্যাংড়া নামে পরিচিতি লাভ করে। খিরসার মতো সুস্বাদু হওয়ায় এই জাতের আমের নাম হয়েছে খিরসাপাত।
সবচেয়ে নামি জাতটি আশ্বিন মাস পর্যন্ত গাছে থাকতে পারে বলে আশ্বিনা নাম দেওয়া হয়েছে। উপজেলায় ৮ হাজার ৫‘শ ৭০ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে বলে জানান এই কৃষি অফিসার।