স্বামী সাক্ষাত হলনা মরিয়মের

প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৩; সময়: ৩:১৮ am | 
খবর > বিশেষ সংবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক : সৌদি আরবে সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে চারজন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার। এদের মধ্যে বারইপাড়া গ্রামের চাচা-ভাতিজাসহ তিনজন ও মাধাইমুড়ি গ্রামের একজন।

যাদের মধ্যে সাত বছরের প্রবাসী রুবেল হোসাইন নয় মাস ছয়দিন আগে মোবাইল ফোনে ভিডিও কনফারেন্সে বিয়ে করেন। প্রেম করে বিয়ে হলেও স্বামীর সঙ্গে সাক্ষত হওয়ার আগে বিধবা হলেন কলেজছাত্রী মরিয়ম আক্তার। স্বামীর মৃত্যু সংবাদে থামছেই না তার আহাজারি।

শনিবার সন্ধ্যায় সরজমিনে রুবেল হোসাইনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় মরিয়ম আক্তার মোবাইল ফোনে স্বামীর ছবি দেখে প্রলব করছিলেন। আমার স্বামিকে একটার বার হলেও দেখতে চাই রে…। আমার স্বামিক আমি কাছ থেকে দেখিনি রে…। আপনাদের পায়ে ধরি রে…; আমার স্বামিক একনা এনে দেন…রে ভাই। আমার স্বামিক কোন দিন চোখের কাছ থেকে দেখিনি রে…। যা দেখেছি দুরে থ্যাকা…রে। যত কথা কছে দুরে থ্যাকাই কথা কছে রে…।

আমি মোবাইল ভাংগিছি তাই একটা কথা কইনি রে…। সাথে সাথে মোবাইল কিনে দিয়েছে। বিয়ের আগেও দুইটা মোবাইল ভাংগিছি রে…। উনি আমাক কিনে দিছে রে…।

মোবাইলে স্বামীর ছবি দেখে কাঁদতে কাঁদতে মরিয়ম বলছিলেন, আমার রুবেল বড় বড় চুল রাখতো রে…। ঈদের আগে আমি বলে চুল কাটিয়েছি রে…। বলে তাকে বলছিল রে…; মায়ের কথায় চুল কাটিসনি; বউয়ের কথায় চুল কাটলু। আরেক ছবি দেখে বলছিলেন এই গেঙ্গি পড়ে আমার রুবেল মারা গেছে রে…।

মরিয়ম জানান, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে তাদের শেষ কথা হয়। দেশে আসার জন্য শুক্রবার কাগজপত্র জমা দিয়ে কারখানায় যাবেন বলে স্ত্রীকে জানিয়েছিল রুবেল। শুক্রবার রাতে আবার কথা বলবে বলেছিল। রাতে কলও দিয়েছিল মরিয়ম। কিন্তু ফোন বাজে কেউ রিসিভ করেনি। রাত নয়টা পর্যন্ত ফোন বেজেছে। এর পর ফোন আর বাজেনি। শনিবার সকাল ৮টার দিকে রুবেলের প্রবাসী বড় ভাই ফোন করে জানায় রুবেল মারা গেছে।

তিন ভাইয়ের মধ্যে রুবেল সবার ছোটে। স্থানীয় দালালকে ১৬ কাঠা জমি লিখে দেওয়া ছাড়াও দেড় লাখ টাকা নগদ দিয়ে ২০১৬ সালে সৌদি আরব পাড়ি জমান রুবেল। তার বড় দুইভাই আগে থেকেই প্রবাসী। বড়ভাই সৌদি আরব এবং মেজে ভাই দুবাই থাকেন।

বারইপাড়া গ্রামের শাহাদাত হোসাইনের একমাত্র ছেলে আরিফ হোসেন রুবেল সৌদি আরব যান আট মাস। ২০১৬ সাল থেকে প্রবাসী চাচা সাজেদুল ইসলাম আরিফকে নিয়ে যান। কাজের ব্যবস্থা করেন একই কারখানায়। শুক্রবার আল আহসা শহরের হুফুফ শিল্প এলাকার ওই সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান চাচা-ভাতিজা। স্বামী হারিয়ে সাজেদুলের স্ত্রী শোকে পাথর হলেও ছেলে হারানোর শোক সইতে পারছে না আরিফের মা। এ শোক ক্যাম করে সইবো আরিফের মায়ের এই আর্তনাতে বাতাস ভারি হয়ে উঠে বারইপাড়া গ্রামের বাতাস।

নিহত আরেকজন ফিরোজ আলী সরদারের বাড়ি পাশের গ্রাম মাধাইমুরি। তিনি আনিসুর রহমানের ছেলে। সাড়ে তিন বছর ধরে সৌদি আরবে রয়েছেন ফিরোজ।

খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যদের শান্তনা দিয়ে নিহতের বাড়িতে যান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। উপজেলার ঝিকড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রবাসীদের গ্রাম নামে পরিচিত বারইপাড়া গ্রাম। এ গ্রামের প্রায় দেড়শো প্রবাসী রয়েছে। সচ্ছল প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকে প্রবাসী রয়েছে।

তিনি বলেন, চার প্রবাসীর মৃত্যুতে শুধু পরিবারের ক্ষতি তা নয়। এটি দেশেরও ক্ষতি। আমরা চাই নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া হোক। এছাড়াও নিহতদের পরিবার যেন ক্ষতিপুরণ পায় সে ব্যাপারে যেন সরকার ব্যবস্থা গ্রহন করে।

নিহতদের বাড়িতে গিয়ে লাশ ফেরত আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ^াস দেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত চলতি দায়িত্ব) সুমন চৌধুরী। তিনি বলেন, লাশ নিয়ে আসার জন্য একটি ফরম পুরণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। সে কাজটি আমরা দ্রুত করবো। এ ক্ষেত্রে যত সহযোগিতা দেয়ার প্রয়োজন আমরা দিব।

সৌদি আরবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত বাগমারার চার শ্রমিক (ওপরে বা থেকে) রুবেল হোসেন, সাজেদুল ইসলাম, (নিচে বা থেকে) আরিফ ওরফে রুবেল আলী ও ফিরোজ আলী সরদার

শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ হতে ৩৫০ কিমি পূর্বে অবস্থিত আল আহসা শহরের হুফুফ শিল্প এলাকায় একটি সোফা কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৯ বাংলাদেশি ও ১ ভারতীয়সহ মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও ২ জন।

অগ্নিকাণ্ডে জীবিত উদ্ধার হওয়া প্রবাসী বাংলাদেশি বিপ্লব হোসেন ও মো: জুয়েল হোসেন জানান, এক ভারতীয় নাগরিকের পরিচালনায় সোফা কারখানাটিতে ১৪ জন বাংলাদেশি কাজ করতেন। শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর কারখানার ওপরে তৈরি কর্মীদের থাকার জায়গায় তারা ঘুমিয়ে ছিলেন।

হঠাৎ নীচ থেকে ‘আগুন, আগুন’ চিৎকার শুনে তারা দুজন দ্রুত সিড়ি দিয়ে নেমে আসার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে চারদিকে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এর মধ্যে কোনোভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন তারা। কিন্তু তাদের অন্য সহকর্মীরা বের হতে পারেননি। ধোঁয়ায় নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। তিনজন কর্মী ঘটনার সময় কারখানার বাইরে ছিলেন।

অগ্নিকাণ্ডে মৃত ৯ বাংলাদেশির পরিচয়ই পাওয়া গেছে। এরা হলেন, ১. মোঃ রুবেল হোসাইন, পাসপোর্ট নম্বর: বিসি০২৩৭০৫৫, পিতা: জফির উদ্দিন, ঠিকানা: বারইপাড়া, বাগমারা, বাগমারা, রাজশাহী।

২. মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম, পাসপোর্ট নম্বর: এই৬৩২৬৮৪১, পিতাঃ জমির, ঠিকানাঃ বারইপাড়া, বাগমারা, বাগমারা, রাজশাহী;

৩. আরিফ (ইকামা নম্বর: ২৫৩৫১৭৬৩৩৯, পিতাঃ মোঃ শাহাদাত হোসাইন, ঠিকানা: বারইপাড়া, বাগমারা, বাগমারা, রাজশাহী;

৪. মোঃ ফিরুজ আলী সরদার, পাসপোর্ট নম্বর: ইই০৫৮১২৭৪, পিতাঃ মোঃ আনিসুর রহমান সরদার, ঠিকানাঃ বড় মাধাইমুরি, কাতিলা, বাগমারা, রাজশাহী।

৫. মোহাম্মদ উবায়দুল, ইকামা নম্বর: ২৩৮৪১৯৭৮৯৯, পিতাঃ মোঃ দবির উদ্দিন, ঠিকানা: খাজুরা চান্দপুর, জনার্ধন বাটী, নলডাংগা, নাটোর;

৬. রমজান, ইকামা নম্বর: ২৪৭২৪৭০৫৮৮, পিতাঃ আইজাক প্রামাণিক, ঠিকানা: ঝনঝনিয়া, শাহগুলা, আত্রাই, নওগা;

৭. বারেক সরদার, ইকামা নম্বর: ২২৪৭৪৩৯৮৫০, পিতাঃ রহমান সরদার, ঠিকানা: উদয়পুর, ভাংগা জাঙ্গাল, আত্রাই, নওগাঁ;

৮. মোঃ জুবায়েত ঢালী, পাসপোর্ট নম্বর: বিডব্লিউ০৬৭৩৪০৭, পিতাঃ ইউনুস ঢালী, ঠিকানা: সস্তান, ফাসিয়াটুলা, কালকিনি, মাদারীপুর;

৯. সাইফুল ইসলাম, ইকামা নম্বর: ২৫২৯৯২২৩২৬, পিতাঃ মৃত আলাউদ্দীন, ঠিকানাঃ হেমায়েতপুর-বলিয়ারপুর, নগরকুন্দা, সাভার, ঢাকা;

অগ্নিকাণ্ডে মৃতদের মরদেহ হুফুফের কিং ফাহাদ হাসপাতালের মর্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া আহত দুজনও একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মর্মান্তিক এ ঘটনায় সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মৃতদের পরিবারের প্রতিও গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি।

সেই সঙ্গে মৃতদের পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী লাশগুলো দ্রুত বাংলাদেশে পাঠানো ও স্থানীয়ভাবে দাফনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য দূতাবাসের শ্রমকল্যাণ উইংকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এছাড়া আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সার্বিক সহায়তার নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। রিয়াদস্থ শ্রম কল্যাণ উইং বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন