আমদানির প্রতি ধাপে সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২৩; সময়: ১১:০৭ am | 
খবর > অর্থনীতি

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে হাতেগোনা কয়েকটি গোষ্ঠী।

এক সময় আমদানিকারকরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করলেও এখন আমদানি থেকে বাজারজাতকরণ— প্রতিটি ক্ষেত্রে একে অন্যের পরিপূরক তারা। এতে বাজারের ওপর একক কর্তৃত্ব তৈরি হয়েছে তাদের। আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা।

এদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের অনেকে আমদানিকারক ভুগছেন ডলার সঙ্কটে। সিন্ডিকেটের সম্মিলিত আগ্রাসনে টিকতে না পেরে বাণিজ্য থেকে সরে দাঁড়াতে হচ্ছে অনেককে।

মূলত দেশের বাজারে চিনি, ডাল ও তেলসহ ১৭টি পণ্যকে নিত্যপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলপণ্যগুলো আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করণে দেখা যায়, মার্কেট শেয়ার বড় কয়েকজন আমদানিকারকের হাতে।

নিত্যপণ্য আমদানি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যে পাওয়া গেছে ভয়াবহ এক চিত্র। জানা গেছে কীভাবে পণ্য আমদানি থেকে শুরু কর খুচরা বাজার পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা একজোট হয়েছে। তারা ভাগাভাগি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

তাদের ধাপটে আমরা ছোটরা ছিটকে গেছি। তাদের অবাধ্য হয়ে এখানে কোনো ব্যবসা করতে পারব না। এখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু কল্পনাও করা যায় না।

আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর মতে— বড় ভলিউমে পণ্য আমদানি করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একজোট হয়েছে। এখন মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ওই বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছ থেকে নিজের ইচ্ছে মতো পণ্য কিনতে পারেন না।

দেশের বাজারে এই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। তারা পুরো সাপ্লাই চেনটা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত নিজেদের বলয় তৈরি করেছে। তাদের শর্ত মতোই সব হচ্ছে।

তাদের কথা মতো না হলে অন্যরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। যেকোনো পরিবেশেই হোক ব্যবসা বাণিজ্যে এই পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক।

উদাহরণ হিসেবে ধরুণ, একজন উদ্যোক্তা ভাবলেন, তিনি ১০০ কোটি টাকার চিনি বা লবণ কিনবেন। সহযোগিতার জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে তারাই ঠিক করে দেন কোন পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে।

এতে রাজি না হয়ে ওই উদ্যোক্তা ব্রাজিল থেকে ১০০ কোটি টাকার চিনি আমদানি করলেন, পরবর্তীতে বড় গোষ্ঠীরা ওই উদ্যোক্তার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে চিনি ছেড়ে দেবে। এতে বড় লোকসানে পড়তে হবে নতুন উদ্যোক্তাকে।

আবার চক্রের বাইরের কেউ আমদানির জন্য এলসি খুলতে চাইলেও কোনো ব্যাংক রাজি হয় না। এমনকি বাধা আসে কাস্টমস ও ভ্যাটসহ বিভিন্ন দফতর থেকে।

এর চাইতেও ভয়ংকর বিষয় হলো, সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে বা তাদের সিগন্যাল ছাড়া পণ্য আমদানি করলে সেগুলো বন্দরে আনতে লাইটার ভেসেল পাওয়া যায় না।

এছাড়া পণ্য খালাসে কাজ করতে আগ্রহী হয় না শ্রমিকরাও। এতে আমদানি করা পণ্য কতদিন সাগরে থাকবে বা কবে নাগাদ খালাশ হবে সেই নিশ্চিয়তা পাওয়া যায় না। আবার খালাস হলেও কাস্টমস ও কর বিভাগ ছাড়পত্র দেবে কি না সংশয় থাকে তা নিয়েও।

আরেক ব্যবসায়ী বলেন, পণ্য আমদানির প্রতিটি ধাপ এভাবেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সিন্ডিকেট। টাকা থাকলেও সিন্ডিকেটের সাথে কেউ পেরে উঠে না।

এমনকি বিভিন্ন সময় সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দিলে তারা ওই পণ্য জাহাজেই রেখে দেন। এতে কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়। এরপর চাপে পড়ে সরকার তাদের বলতে বাধ্য হয়; দাম যাই হোক, পণ্য আনুন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিন্ডিকেট পরিচালনাকারীরা বেশিরভাগই বড় আমদানিকারক। দেশের ব্যাংকগুলোর মালিকানা বা ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্বেও তারাই আছেন।

আবার সাগরের বড় জাহাজ থেকে বন্দরে পণ্য খালাসে সেসব লাইটার ব্যবহার করা হয় সেগুলোর মালিকও তারা বা তাদের সহযোগীরা। ফলে বন্দরে পণ্য খালাসে কাজ করা শ্রমিকরাও তাদের বাইরে গিয়ে অন্যের কাজ করতে পারে না।

কারণ এতে বিপদে পড়তে হয় তাদের। এমন সবকিছুতে নিজেদের কর্তৃত্ব থাকায় সরকারের রাজস্ব বিভাগের লোকজনও থাকেন তাদের চাপের মুখে।

এক ব্যবসায়ী বলেন, আপনার যত টাকা থাকুক, সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে কেউ পণ্য আনার জন্য কোনো ব্যাংকে এলসিই খুলতে পারবেন না। কারণ ব্যাংকও তাদের।

হাই কানেক্টেড (উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ) না হলে ব্যাংক কারও এলসি খুলবে না। আবার কোনো পণ্য এনে যাদের মাধ্যমে বাজারজাত করা হবে সেসব প্রতিষ্ঠানও নামে বেনামে তাদেরই মালিকানাধীন।

অথবা তাদের পরিবারের লোকজনের। এমনকি বড় বড় বাজারগুলোর জন্য এসব পণ্যের ডিলারশিপও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনের হাতেই যায়।

নিত্যপণ্য আমদানি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যে পাওয়া গেছে ভয়াবহ এক চিত্র। জানা গেছে কীভাবে পণ্য আমদানি থেকে শুরু কর খুচরা বাজার পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা একজোট হয়েছে। তারা ভাগাভাগি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

তাদের ধাপটে আমরা ছোটরা ছিটকে গেছি। তাদের অবাধ্য হয়ে এখানে কোনো ব্যবসা করতে পারব না। এখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু কল্পনাও করা যায় না।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম একজন গবেষক ও অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা যে দামে অন্যদের কাছে পণ্য বিক্রি করেন- তারা মানি রিসিট দিতে চান না, যা রীতিমতো অপরাধ।

মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে— দেশের বাজারে এই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। তারা পুরো সাপ্লাই চেনটা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত নিজেদের বলয় তৈরি করেছে।

তাদের শর্ত মতোই সব হচ্ছে। তাদের কথা মতো না হলে অন্যরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। যেকোনো পরিবেশেই হোক ব্যবসা বাণিজ্যে এই পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক।

তিনি বলেন, বড় গোষ্ঠীগুলো শুধু পণ্য আনাটাই নয়, জাহাজ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে। সরকারের সঙ্গে দাম নিয়ে আলোচনা হলে, বাজেটে শুল্ক হ্রাস বৃদ্ধির বিষয় থাকলে, অথবা সরকার দাম কমানোর বা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে—সে সময় হয়তো তারা জাহাজ সাগরেই রেখে দেবেন।

এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভোক্তারা। ঝুঁকিতে থাকবে বাজার ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে বাজারের মূল্যবোধ, ভ্যালুজ, সংস্কৃতি সবই নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।

আপনার যত টাকা থাকুক, সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে কেউ পণ্য আনার জন্য কোনো ব্যাংকে এলসিই খুলতে পারবেন না। কারণ ব্যাংকও তাদের। হাই কানেক্টেড (উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ) না হলে ব্যাংক কারও এলসি খুলবে না।

আবার কোনো পণ্য এনে যাদের মাধ্যমে বাজারজাত করা হবে সেসব প্রতিষ্ঠানও নামে বেনামে তাদেরই মালিকানাধীন। অথবা তাদের পরিবারের লোকজনের। এমনকি বড় বড় বাজারগুলোর জন্য এসব পণ্যের ডিলারশিপও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজনের হাতেই যায়।

বাজারের এই সমস্যার সমাধান ও সরকারের করণীয় সম্পর্কে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন— টেলিকম খাতের মতো নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও ডমিন্যান্ট মার্কেট প্লেয়ারদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত।

তারা কোন পণ্য কি দামে কতটুকু আনছে, কত দামে বিক্রি করছে, কতটা কোথায় মজুত আছে— এই সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য থাকা দরকার।

এসব পণ্যের ব্যবসায়ীদের রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম চালু করে ব্যাংক লেনদেনের আওতায় এনে প্রতিটি লেনদেনের অনলাইন আপডেট হওয়া উচিত।

তার মতে, দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতা তৈরি করা না গেলে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা না থাকলে ভোক্তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আবার দেশে যারা উৎপাদন করেন তারাও বিপদে পড়বেন।

প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, আমাদের টাস্কফোর্স আছে। বাজারের এই অস্থির চিত্র সম্পর্কে অবগত রয়েছি। এনিয়ে কাজ চলছে।

বিভিন্ন দফতরকে সঙ্গে নিয়ে একটি সমীক্ষা করছি। সমীক্ষার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করবো। এছাড়া সিন্ডিকেটের লোকজনের বিরুদ্ধে ৬০ থেকে ৭০টি মামলা করেছি। মামলাগুলো এখন শুনানি পর্যায়ে আছে।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন