নির্বাচনী প্রচারে জড়াচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরাও

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল মমিন মণ্ডলের পক্ষে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়েছেন চৌহালী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আরিফ সরকার। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের নৌকার প্রচার চালাতে এবং ভোট দিতে নানাভাবে চাপ সৃষ্টিও করেন তিনি। এমন অভিযোগে ইতোমধ্যে তাকে তলব করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।
নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুর পক্ষে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সায়মা আফরোজ। এ অভিযোগে তাকে শোকজ করা হয়েছে।
সরকারি চাকরিবিধি এবং নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে যুক্ত হয়েছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চাকরিরত ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন শিক্ষক কিংবা পুলিশ সদস্যরাও। শুধু তাই নয়, আইনপ্রণেতা হওয়ার বাসনায় সরকারি চাকরির তথ্য গোপন করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছেন কেউ কেউ। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদের নিয়মিত শোকজ, তলব ও বদলি করা হচ্ছে। আরও গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের থামাতে আরও কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরুর আগে ও পরে নানাভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলেছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। এ তালিকা থেকে বাদ যাননি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গতকাল পর্যন্ত আড়াই শাতধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থককে শোকজ ও তলব করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরাও রয়েছেন।
বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিয়মিত আদালতে মামলাও হয়েছে। প্রার্থী ও সমর্থকদের পাশাপাশি আচরণবিধি ভঙ্গের কারণে পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে কর্মরত অনেক শোকজ, তলব ও বদলি করা হয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল মমিন মণ্ডলের পক্ষে নৌকা প্রতীকে সরাসরি ভোট চান চৌহালী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আরিফ সরকার। সরকারি চাকরিজীবী হয়েও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের নৌকার প্রচার চালাতে এবং ভোট দিতে চাপ সৃষ্টি করেন তিনি। এমন অভিযোগে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির কর্মকর্তা ও শাহজাদপুরের সিনিয়র সহকারী জজ মো. সোহেল রানা তাকে তলব করেন। গতকাল আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে তিনি তার অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এর আগে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি অংশগ্রহণ করায় আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. সায়মা আফরোজকে শোকজ করেন নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি ও সিনিয়র সহকারী জজ ধীমান চন্দ্র মণ্ডল।
শোকজ নোটিশে বলা হয়, ‘বিভিন্ন সময় সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আপনার নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৭৭(১)ঙ এবং ৮৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আপনার কর্মকাণ্ডের জন্য আপনার বিরুদ্ধে ওই আইন ভঙ্গের দায়ে বিধি মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য নির্বাচন কমিশন বরাবর কেন সুপারিশ করা হবে না- সে মর্মে ২৫/১২/২০২৩ তারিখ দুপুর ১২টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনে স্বাক্ষরকারীর কার্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে অথবা কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য আপনাকে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’ সোমবার তিনি তার লিখিত জবাব দিয়েছেন।
ইসি সূত্র জানায়, সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়মিত আসছে। দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনী প্রচারে জড়িয়ে পড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বেশিরভাগই এলাকার সরকারি কলেজ ও স্কুলের শিক্ষক।
সম্প্রতি পাবনা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন যে, ওই আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর বাসায় এক বৈঠকে কয়েকজন শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারী সরাসরি নৌকার পক্ষে ভোট চান। তাদের মধ্যে রয়েছেন বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন, বেড়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক, বেড়া পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত সচিব হারুনুর রশিদ।
এর আগে সরকারি চাকরির তথ্য গোপন করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার এক স্বাস্থ্য সহকারী। বিষয়টি জানার পর তার বিরুদ্ধে চাকরি বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। মোহাম্মদ সালাউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
মনোনয়নপত্রে তিনি সরকারি চাকরির তথ্য গোপন করে নিজের পেশা দেখিয়েছেন ব্যবসা। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে ১ শতাংশ ভোটারের তথ্যে গরমিল থাকায় তার প্রার্থিতা বাতিল করেছিলেন জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা। পরে উচ্চ আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান সালাউদ্দিন। ভোটে লড়তে তিনি ‘রকেট‘ প্রতীক পেয়ে প্রচারও শুরু করেন।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘শোকজ করা হলেও স্বাস্থ্য সহকারী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জবাব দেননি। মাঠে তার পোস্টার দেখা গেছে রকেট প্রতীকে। ওই আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা বিভাগীয় কমিশনার, নির্বাচন কমিশন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিলে আপিল করবে বলে জানা গেছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণবিধি লঙ্ঘন সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, ‘নির্বাচনী আচরণ বিধির ব্যাপারে কমিশন সোচ্চার। সারা দেশে প্রতিদিনই আচরণ বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শোকজ, তলব, জরিমানাসহ মামলা করা হচ্ছে। সরকারি পদে থেকে কেউ বিধি লঙ্ঘন করলেও ছাড়া হচ্ছে না। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’