প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান রাবির সাবেক শিক্ষার্থীর

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাবি : শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় প্রতিবাদস্বরুপ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান করেছেন সাবেক শিক্ষার্থী নুরুল হুদা।
শনিবার (১৩ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এই ঘোষণা দেন তিনি।
নূরুল হুদার বাড়ি লালমনিরহাট জেলার আদিতমারি থানায়। তার পিতার নাম অহর উদ্দীন এবং মাতার নাম রহিমা বেওয়া। এলএল.বি (সম্মান) পরীক্ষার ফলাফলে আইন অনুষদে প্রথম স্থান অর্জন করায় ২০১৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক অর্জন করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নুরুল হুদা জানান, তিনি রাবির ২০১৮ সালের ০৭/২০১৮ নম্বর শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আইন বিভাগে আবেদন করার পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়মের শিকার হন। যার ফলশ্রুতিতে উক্ত নিয়োগে তার চাকুরি হয়নি।
২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন হয় এবং উক্ত নিয়োগ ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৪৮৫ তম সিন্ডিকেটে পাশ হয়।
নিয়োগ বোর্ডের পূর্বমুহুর্তে ৮ নভেম্বর নিয়োগ বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও রাবির তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মোহাম্মদ জাকারিয়া তার স্ত্রীকে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি প্রস্তাবে রাজি হননি।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক জাকারিয়ার ভাগনে ও ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গাজী তৌহিদুর রহমান কৌশলে তার নিকট থেকে জিনিসপত্র মেরামত ও পোশাক কিনিয়ে নেওয়া সহ বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, নিয়োগ বোর্ডের আরেক সদস্য ও আইন বিভাগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হান্নান ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর তার নিকট থেকে ২ লক্ষ টাকা ধার নেন।
প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত নুরুল হুদা জানাম, নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও রাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবাহানকে নিয়োগ বোর্ড এবং সিন্ডিকেটের পূর্বে তার নিকট থেকে অধ্যাপক আব্দুল হান্নানের ধারের বিষয়ে এবং তার স্ত্রীর নিকট উপ-উপাচার্য চৌধুরী জাকারিয়ার অবৈধ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাবের বিষয়ে অবহিত করা হলেও উপাচার্য আব্দুস সোবাহান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই অধ্যাপক আব্দুল হান্নান ও উপ-উপাচার্য জাকারিয়াকে নিয়েই ১৩ নভেম্বর আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন করেন।
উক্ত প্রশ্নবিদ্ধ ও সুবিধাভোগী (ইন্টারেস্টেড) সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশের প্রেক্ষিতে আইন বিভাগে বনশ্রী রানী, সালাউদ্দিন সাইমুম ও নুর নুসরাত সুলতানাসহ মোট তিজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ এলএল.বি (সম্মান) পরীক্ষার ফলাফলে নিয়োগপ্রাপ্ত সকলের থেকে তিনি এগিয়ে ছিলেন।
আরও লক্ষ্যণীয় যে, উপাচার্য আব্দুস সোবাহান দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার পর বিদ্যমান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করে নতুন নীতিমালা প্রনয়ন করেন। পূর্বের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী সালাউদ্দিন সাইমুম ও নূর নুসরাত সুলতানা কেউই শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার যোগ্য ছিলেন না।
নিয়োগের পর সালাউদ্দিন সাইমুমের সাথে উপ-উপাচার্য চৌধুরী জাকারিয়ার মেয়ের বিয়ে হয় এবং নূর নুসরাত সুলতানার সাথে আইন বিভাগের শিক্ষক শিবলী ইসলামের বিয়ে হয়।
এছাড়া বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আইন বিভাগের উক্ত শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডটিকে অবৈধ বলে গণ্য করেছে।
পরে উপাচার্য আব্দুস সোবহান ও উপ-উপাচার্য জাকারিয়া তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিলেন দাবি করে নুরুল হুদা বলেন, উক্ত নিয়োগে তার চাকরি না হওয়ার প্রায় ১০ মাস পর ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তার অজ্ঞাতসারে তার স্ত্রীর নিকট উপ-উপাচার্য চৌধুরী জাকারিয়ার অবৈধ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাবের অডিও রেকর্ড বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়।
তখন উপ-উপাচার্য জাকারিয়া তার নিকট নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং উপ-উপাচার্য জাকারিয়া ও উপাচার্য আব্দুস সোবাহান চাকুরি ও ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব প্রদান করে বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকতে বলেন। কিন্তু তিনি তাদের চাকুরি ও ক্ষতিপূরণের অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হননি।
পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটির নিকট ২০২০ সালের ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর উপস্থিত হয়ে তিনি ও তার স্ত্রী রাবির আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য এবং বিভিন্ন অনিয়মের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেন।
ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ১ ও ২ নং পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ০৭/২০১৮ নম্বর শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে গঠিত আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও রাবির উপাচার্য আব্দুস সোবাহান, নিয়োগ বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও উপ-উপাচার্য চৌধুরী জাকারিয়া, উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার ভাগনে গাজী তৌহিদুর রহমান এবং আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের আরেক সদস্য ও আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হান্নানের বিরুদ্ধে আনীত শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে নুরুল হুদা আরও বলেন, ইউজিসির তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর সম্পন্ন হওয়া আইন বিভাগের উক্ত শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডটিকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণার পাশাপাশি ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য আব্দুস সোবাহানের মেয়ে ও জামাতাসহ মোট ৩৪ জন শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করে।
পাশাপাশি রাবির শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়মের সাথে জড়িত থাকায় উপাচার্য আব্দুস সোবাহান, উপ-উপাচার্য চোধুরী জাকারিয়াসহ প্রায় হাফ ডজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।
ইউজিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপাচার্য আব্দুস সোবাহান ২০২১ সালের ৬ মে তার শেষ কর্মদিবসে একইসাথে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ১৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার নজির সৃষ্টি করেন।
উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে আবারো শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উক্ত নিয়োগের ঘটনায় প্রধান দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় উপাচার্য আব্দুস সোবাহানকে এবং প্রধান সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার জামাত্রা প্রভাষক এটিএম শাহেদ পারভেজকে।
এছাড়া প্রতিবেদনে নিয়োগ কার্যক্রমের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
এরই প্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবারও নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করে এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৬ আগস্ট ২০২৩ আইন বিভাগে আবারো ৩টি পদে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
নুরুল হুদা বলেন, ইউজিসি তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের ১৯.১০ নং পর্যবেক্ষণে মন্তব্য করেছেন, ‘..রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে টাকা লেনদেন একটি ওপেন সিক্রেট বিষয়।
এতে প্রমাণিত হয় যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রাপ্ত প্রার্থীদেরকেও শিক্ষকদের পিছনে ধর্ণা ধরতে হয় কিংবা অর্থ লেনদেন করতে হয়।
শিক্ষক সমাজের অহংকার ড. শামসুজ্জোহার রক্তেভেজা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এ ধরণের ভাবমূর্তি সত্যিই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়।’
সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে আক্ষেপ করে নুরুল হুদা বলেন, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তদন্তপূর্বক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের প্রায় ৩ বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত আইন বিভাগসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আইন বিভাগসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান করছি।
সংবাদ সম্মেলন শেষে পদক প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও ইউজিসি চেয়ারম্যান বরাবর দুইটি পৃথক স্মারকলিপি দিয়েছেন নুরুল হুদা।