অধ্যক্ষের হয়রানিতে নাজেহাল শিক্ষিকা

প্রকাশিত: জুন ১, ২০২৪; সময়: ৩:৫৮ pm | 
খবর > বিশেষ সংবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক : চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলির অত্যাচারে একই কলেজের শিক্ষিকা সৈয়দা রেহানা আশরাফীর জীবন হুমকির মুখে পড়েছে।

কলেজ জাতীয় করনের জন্য ভূমিকা পালন করায় ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাকে ইভটিজিং, র‌্যাগিং, প্রাণনাশের হুমকি, বেতন আটকে রাখা, পেশাগত ক্ষতিসাধন করা, ছবিতুলে ভাইরাল করার হুমকি, চাকরী স্থায়ী করনের প্রতিবন্ধকতা, ছুটির আবেদন মঞ্জুর না করা, মিথ্যা অভিযোগ তুলে জোর পূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া সহ নানান অভিযোগ উঠেছে ওই অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে। এসব অত্যাচারের প্রতিকার চেয়ে ওই কলেজের ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক সৈয়দা রেহানা আশরাফী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সচিব, মহাপরিচালক, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরের অভিযোগ দিয়েও কোন ফলাফল না পাওয়ায় জীবনের নিরাপত্তা দিয়ে দু:শ্চিতায় পড়েছেন।

বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগ বনে যাওয়া এই অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে কথা বললেই হয়ে উঠে আরো বেপরোয়া। দেখান ক্ষমতার দাম্ভিকতা। ফলে ওই কলেজের প্রায় ৩৪ জন শিক্ষক কর্মচারী তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারেন না। কলেজ অধ্যক্ষ হয়েও দিনের পর দিন কলেজে উপস্থিত না হয়ে তার আর্শিরবাদপুষ্ট সহকারি অধ্যাপক রেবিনা খাতুন ও জেসমিন আরা জলিসহ অন্য কর্মচারীদের দিয়ে কলেজ পরিচালনা করে আসছেন।

কলেজ শিক্ষিকা জেসমিন আরা জলি বলেন, অধ্যক্ষ স্যার মাঝে মধ্যে যখন কলেজে আসেন না তখন তো কাউকে না কাউকে কলেজ চালাতে হবে। আমাদের যখন দায়িত্ব দেন তখন দায়িত্ব পালন করিমাত্র। অধ্যক্ষ দীর্ঘদিন কলেজে না আসার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই অধ্যক্ষর বাড়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুরের ভাগ্যবানপুরে হলেও থাকেন রাজশাহী শহরের নওদাপাড়া এলাকায়। অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলি বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর-৩ আসনের সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদের স্ত্রী সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়ার বাড়ীর বেতনভূক্ত কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনিই তাকে কলেজের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু কলেজের পাঠদান থেকে বিরত থেকে এমপি পাপিয়ার সংসারের গৃহস্থালীর কাজ করাকেই বেশী শ্রেয় মনে করতেন। তাই তিনি কখনো কলেজে যেতেন না। এমপির স্ত্রীর কর্মচারী হওয়ার কারণে সকল জবাবদিহিতার উর্দ্ধেও ছিলেন তিনি।

পরবর্তিতে সরকার পরিবর্তন হলে (ওয়ান ইলেভেন) তিনি রাতারাতি বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদু এর সাথে সাক্ষাৎ করে তার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য। চাকরী বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্য, মারামারিসহ নানান অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে হঠাৎ রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে আদেশ নিয়ে আসেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ যুুদ্ধাহত বীরমুক্তিযোদ্ধা এনামুল হকের চাকরী বর্ধিতকরনের আদেশ বাতিল করে ১৪ জন শিক্ষকের জৈষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তিনি অধ্যক্ষের পদ দখল করেন। এখান থেকেই শুরু হয় তার নতুন অধ্যয়ের। তিনি কোন দিনও কলেজে যেতেন না। কদাচিৎ গেলেও সামনে পেছনে শতাধিক অস্ত্রধারী মোটরসাইকেলে তাকে নিয়ে যেতেন। কলেজ চত্ত্বরে বসতো প্রকাশ্যে মাদকের আড্ডা।

অপরদিকে চলতো দরিদ্র পাওনাদারদের টাকা পাওয়ার আকুতি। কিন্তু করো সাথে দেখা করতেন না। পুরো কলেজে শিক্ষক কর্মচারীদের বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সিন্ডিকেট তৈরী করেন। পিয়ন-কর্মচারীদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পায়। একাডেমিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে এবং গুটি কয়েক সৎ, যোগ্য ও পেশাদার মেধাবী শিক্ষক সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন এবং অনৈতিক সুবিধাভোগী শিক্ষক-কর্মচারীদ্বারা অধ্যক্ষর প্রত্যক্ষ মদদে নিগৃহিত হতে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি ২০১৬ সালের মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বীরশ্রেষ্ঠদেরর নামে প্রতিষ্ঠিত মিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহকে সরকারী করণের ঘোষণা দিলে তখন থেকেই নেপথ্যে থেকে কাজ শুরু করেন কলেজ শিক্ষিকা সৈয়দা রেহানা আশরাফী। কলেজ সরকারি করণ হলে অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলি চেয়ারম্যান পদে না থাকাসহ নানান কর্মকান্ডে বাধাগ্রস্ত হবে এই জন্যই তিনি কখনই চাইতেন না কলেজটি সরকারি হোক। তখন থেকেই এই শিক্ষিকার সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় অধ্যক্ষর।

ইউনিয়ন পরিষদের অর্ধ কোটি টাকা আত্মাসাতের অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলির বিরুদ্ধে কলেজ পরিচালনায় অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

ইসলামের ইতিহাস বিষয়ের প্রভাষক সৈয়দা রেহানা আশরাফী বলেন, কলেজটি সরকারী করনের জন্য আমার বিশেষ ভূমিকা থাকায় দীর্ঘদিন থেকেই আমাকে তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়ান। তার অত্যাচারে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এমন অধ্যক্ষ শিক্ষিত সমাজের জন্য শুভকর নয়।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারী অধ্যক্ষ স্যার কলেজের কম্পিউটার অপারেটর আব্দুল মতিনকে দিয়ে তার মোবাইলে গোপনে ছবি তোলে রাখেন। আমি শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর শেষে কলেজ থেকে আসার সময় তিনি উপস্থিত শিক্ষক কর্মচারীদের ছবি প্রদর্শন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এই নিয়ে আমি নিজের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করলেও নানান ভাবে হয়রানী ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জিডি উঠিয়ে নিতে বাধ্য করেন।

পারিবারিক সমস্যার কারণে ২১-০১-২০২১ থেকে ২৫-০১-২০২১ তারিখ পর্যন্ত ছুটির আবেদন করলেও তিনি তা গ্রহণ না করেন হয়রানী মূলক কারণ দর্শানো চিঠি প্রদান করেন। আমি চিঠির জাবাব দিলেওন কলেজে অনুপস্থিত দেখিয়েছেন। ২০২৩ সালে আমার মেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ায় ভর্তির জন্য ১-১০-২০২৩ থেকে ৩-১০-২০২৩ পর্যন্ত তিনদিনের ছুটি নিয়ে গেলেও আমাকে পুনরায় হয়রানি মূলক কারণ দর্শানো চিঠি প্রদান করেন। চিঠির জাবাব দিলেও তা নিষ্পপ্তি করা হবে না বলে হুমকি দেয়। পরে তিনি ওই সময় আমাকে কলেজে অনুপস্থিত দেখিয়ে তিন দিনের বেতনের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করে বলেন।

তিনি আরো বলেন এসবের প্রতিকার চেয়ে আমি গত ২১ নভেম্বর ২০২৩ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সচিব বরাবর অভিযোগ দিলে গত ২৩ জানুয়ারী ২০২৪ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো: তানভীর হাসান স্বাক্ষরিত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক (কলেজ) ড. মো আলমগীর হোসেন ও সহকারী পরিচালক (কলেজ) মো: আলমাছ উদ্দিনের সমন্বয়ে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। পত্র প্রাপ্তির ১৫ কর্মদিবনের মদ্যে তদন্তপূর্বক সুস্পষ্ট মতামতসহ দুই প্রস্থ তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণের দির্দেশ প্রদানের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞান কারণে কোন ফল এখনো পাননি ভূক্তভোগী শিক্ষিকা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ এজাবুল হক বুলি বলেন, এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন এবং তদন্তও হয়েছে। সেই তদন্ত আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। কলেজের কোন শিক্ষকের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখেন না। তিনি বিভিন্ন সময়ে ছুটি না নিয়েই কলেজ উপস্থিত হয়নি। সেগুলোর প্রমাণ আমার কাছে আছে।

এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক ড. মো: আলমগীর কবীর বলেন, ওই কলেজের অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো আমরা সরেজমিনে তদন্ত করেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে ওই কলেজের নানান সমস্যা রয়েছে। আমরা তা ঠিক করার জন্য যাদের যেমন নির্দেশনা দেওয়া দরকার দিয়েছি। আর তদন্তর মূল প্রতিবেদন আমরা তৈরী করছি তৈরী হলেই ঢাকায় পাঠানো হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

এবিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস দিয়ে কোন সাড়া না পাওয়ায় বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন