গরিবের চাল চেয়ারম্যানের পেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক, জয়পুরহাট : জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়াজেদ আলীর বিরুদ্ধে দুস্থদের চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। চাল বিতরণের তালিকায় নাম থাকলেও চাল পাননি অনেক উপকারভোগী। এ ইউনিয়নের ১৯ জন উপকারভোগীর নামে বরাদ্দের ২৪ মাসের মধ্যে ১৮ মাস চাল উত্তোলণ করেছে চেয়ারম্যান নিজেই। গত জুলাই ও আগস্ট মাসের চাল বিতরণ করতে গিয়ে এসব উপকারভোগী ইউনিয়ন পরিষদে চাল নিতে না আসায় এমন রহস্য বের হয়ে আসে। ইউপি সদস্যরা বলছেন, শুধু ১৯ জনই না, তালিকা ধরে খোঁজ নিলে আরও অনেকেরই নাম বের হয়ে আসবে।
গত বৃহস্পতিবার উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলার বেশকয়েকটি মামলায় আসামী হন উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী। মামলার পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম। ভিজিডি’র কার্ডধারী হতদরিদ্রদের গত জুলাই ও আগস্ট মাসের বরাদ্দের চাল আসে ইউনিয়ন পরিষদে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে কার্ডধারী ৪২৯ জন উপকারভোগীকে প্রতিমাসের ৩০ কেজি করে চাল নিতে ইউনিয়ন কার্যালয়ে আসতে বলা হয়। এদের মধ্যে ১৯ জনের চাল গত এক মাসে কেউ নিতে আসেননি। গত দুই মাসের ১৯ জনের মোট ৩৮ বস্তা চাল ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে মজুত থাকতে দেখা গেছে।
ভূক্তভোগী, ইউপি সদস্য ও এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত দুই মাস ধরে বিতরণ না হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের গুদামে ১৯ জন দুস্থ্যর মোট ৩৮ বস্তা চাল মজুত রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের পক্ষে তালিকা ধরে ভূক্তভোগীদের বাড়ীতে গিয়ে কথা বলা হয়। ১৩ জন কার্ডধারীর সন্ধ্যান পেয়েছেন তাঁরা। ৬ জনের সন্ধ্যান এখনও পাননি। তবে যাদের সন্ধ্যান পেয়েছেন তারা বরাদ্দের বিষয়ে গত ১৮ মাস ধরে কিছুই জানেননা। এমনকি তাঁরা কখনও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৩০ কেজি তো দুরের কথা, এক ছটাক চালও উত্তোলণ করেননি। শুধু ১৯ জনই নয়, ভালভাবে খোঁজ নিলে ওই তালিকা থেকে কমপক্ষে আরও ৫০ জনেরও বেশী নাম বের হয়ে আসবে বলে জানান বর্তমান ইউপি সদস্যরা। গত ১৮ মাসে যে তথ্য জানা যায়নি, তা এক মাসেই বের হয়ে আসে।
তালিকায় নাম আছে কিন্তু ১৮ মাস ধরে চাল পাননি ভূক্তভোগী দূর্গাপুর-বহুতী গ্রামের বাসিন্দা মোছা. মাহমুদা। তিনি বলেন, আমিতো চালের বিষয়ে কিছুই জানিনা। কয়েকদিন আগে লোকজন এসে বলছে, তোমার চাল গুদামে আছে, তুমি কেন নিয়ে আসোনি। আমি তাদের বলেছি কিসের চাল, আর আমি কেন চাল নিয়ে আসবো। পরে সবকিছু বুঝিয়ে বললে আমি তাঁদের বলেছি, চাল দিলে গত ১৮ মাসসহ দিতে হবে।
চাল না পাওয়া আরেক ভূক্তভোগী মান্দাই গ্রামের মোছা. দেলোয়ারা বলেন, চাল বরাদ্দ হয়েছে আমাদের মত গরিবের নামে, আর সেই চাল গত ১৮ মাস ধরে বিক্রি করে খাচ্ছেন চেয়ারম্যান নিজেই। কথায় বলে গরিবদের নাকি আল্লাহতালাও পছন্দ করেনা আর চেয়ারম্যানই বা করবে কেন ? আমরা তার উপযুক্ত শাস্তি চাই।
উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নং ওয়ার্ড সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, মামলার পর চেয়ারম্যান পালিয়ে না থাকলে হয়তো এসব কিছুই জানা যেত না। আগে কাউকে কিছুই জানতে বা বুঝতেও দিতো না। ১৯ জন ভূক্তভোগী চাল নিতে না আসায় আজ সবকিছু পরিস্কার। তাছাড়া বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলামও এই চালগুলোও বিক্রি করতে চেয়েছিল। আমরা বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবগত করেছি। এরপর তিনি ওই চাল আর বিক্রি করতে পারেনি। আমরা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানেও শাস্তি চাই।
উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জুলাই ও আগস্ট মাসের চাল আসছে। সকল ইউপি সদস্যকে সাথে নিয়ে তালিকা ধরে চাল বিতরণ করেছি। এরমধ্যে ১৯ জন কার্ডধারী প্রথমদিনে চাল নিতে আসেনি। ভেবেছিলাম পড়ে আসবে। কিন্তু গত একমাস অতিবাহিত হয়ে গেলো তাঁরা আসেনি। আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে এ বিষয়ে অবগত করেছি।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার মাহফুজা খাতুন বলেন, নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে তালিকা অনুযায়ী চাল নিতে না আসা কার্ডধারীদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। কার্ডধারীরা জানান তাঁদের নামে চাল বরাদ্দের বিষয় গত ১৮ মাস ধরে জানেন না কেউ। তবে এটা দুঃখজনক। ১৯ জনের মধ্যে ১৩ জনের সাথে কথা হয়েছে, এখনও ৬ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে তদন্ত চলমান রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামিমা আক্তার জাহান বলেন, ভূক্তভোগীদের মধ্যে বেশকয়েক জনের সাথে কথা বলেছি, তারা গত ১৮ মাসের চাল চায়। আসলে আমি কোথায় থেকে তাদের ১৮ মাসের চাল দিব। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তাঁদের অভিযোগ প্রমানিত হলে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।