আমার তিনটি মা যেন সোনার প্রতিমা

এ কে সরকার শাওন : জগলু ও তার কক্ষ সংগী কবীর টাঙ্গাইলের আকুর টাকুর পাড়াস্থ কবীরের ভগ্নীপতির বাড়ী এসে পৌছালো দুপুর ৩ টায়। কবীরের বড় বোন নাজমা পারভীন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আর ভগ্নীপতি বিমান বাহিনীর এটিআই এর বিমান প্রকৌশল বিভাগের প্রশিক্ষক। তাদের ত্রিমজ কন্যাদের আজ জন্মদিন। সেই জন্য কবীরের অনুরোধে জগলুর বেড়াতে আসা।
গতকাল জগলু তিন ভাগ্নীর জন্য উপহার কিনতে গিয়েছিল টুকিটাকি চত্বরে। কবীর কিনতে না দিয়ে বললো
-তোর কোন উপহার কেনা দরকার নাই। তুই আমার ত্রিমজ ভাগ্নীদের নিয়ে একটি ছড়া বা গান লিখে দিলেই আমরা সবাই খুশী।
তাই গত রাতেই তিন কন্যাদের জন্য একটি গান লিখে সুরও করে রেখেছে জগলু । জগলু কবীরকে বললো
-গানটি তুই-ই গাইবি কিন্তু!
কবীরঃ তুই লিখছোস তুই গাইলেই ভালো হবে।
আমি এগুলো পারি না-কি?
বাড়ীতে ঢুকতেই কবীর পরিচয় করিয়ে দিলো
-জগলু, উনি আমার দুলাভাই,
দুলাভাই, এ আমার কক্ষ সংগী জগলু
সালাম বিনিময়ের পর ভদ্রলোক করমর্দন করে বললেন
– মোঃ আবদুল কাদের সরকার। বসো ভাই।
জগলুঃ আপনার কর্মক্ষেত্র তো পতেঙ্গা?
কাদেরঃ হুম
জগলুঃ পতেঙ্গার নাম শুনতেই তরমুজের কথা মনে হয়।
কাদেরঃ নিয়ে আসছি তোমাদের জন্য!
কবীরের বোন সামনে এসে বললো
নাজমাঃ তুমিই জগলু? তাই না?
জগলুঃ জ্বী আপা, আপনি কেমন আছেন?
নাজমাঃ ভালো আছি। আমরা পরে গল্প করবে। এখন আহার চৌপায়ায় আসো। আগে খেয়ে নাও।
জগলুঃ তিন রাজকন্যা তৃষা, তৃণা ও তূর্ণা ওরা কোথায় আপা?
নাজনাঃ ওরা ঘুমে। একটু পর উঠে বাড়ীটা মাতিয়ে রাখবে। এসো, খাবার জুড়িয়ে যাবে।
ওরা তিনজন পাশের কক্ষে চলে গেলো।
বিকেলে ৫ টা, একটি বিশাল কক্ষের এক প্রান্তে রং-বেরং এর অক্ষর দিয়ে লিখা “তিন রাজকন্যার তৃতীয় জন্মদিন”। কক্ষটাকে জরি, ফানুস, কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। সন্ধ্যার পরে আলোকসজ্জা হবে। চৌপায়াতে একটি কেক ও ছুরি রাখা আছে। তৃষা, তৃণা ও তূর্ণার দু’পাশে বাবা মা। ওদের বাবার পাশে জগলু ও মায়ের পাশে কবীর।
প্রথমে এতটুকু একটি শিশু তৃষামনি শামসুর রাহমানের “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা” কবিতাটি তার বাবার সাথে আবৃত্তি করে শোনালো।
উৎফুল্ল সকলেই হাততালি দিলো। সকলের তালি থামার পরও জগলুর হাততালি চলতেই থাকলো। সে বললো
-আমি অভিভূত বাবা ও মেয়ের দ্বৈত আবৃত্তি শুনে। এক কথায় অসাধারণ।
এরপর কবীর সাদামাটা ভাবে বললো
-আমাদের তিন মা মনিদের নিয়ে আমার বন্ধু জগলু একটি গান লিখেছে। এবারে সে সেই গানটি গেয়ে শোনাবে। হয়ে যাক একটি হাততালি।
হাততালি শেষ হবার পর জগলু বললল
-ওদের আজই প্রথম দেখলাম। কবীরের কাছে ওদের গল্প শুনতাম। আজ জন্মদিনের সাজে ওদের ভারী মিষ্টি লাগছে। ওদের বাবা মায়ের স্বপ্ন বড় হয়ে ওরা একদিন বিশ্ব জয় করবে। কবীর ওদের বাবার কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কোন মেয়ে বড় হয়ে কী হবে; আমি গানটি সেইভাবেই লিখেছি। তাই আমি অনুরোধ করবো দুলাভাইকে আমার পাশে থাকতে। কারণ গানটি তিনি গাইলেই সবচেয়ে ভালো হবে। ওদের বাবা মায়ের স্বপ্ন সার্থক হোক।
কবীর বললো
-এবার শুরু…
জগলু ও কাদের সাহেব গান ধরলো
আমার তিনটি মা
যেন সোনার প্রতিমা!
তারা অনন্যা
তাদের নেইকো উপমা!
আমার তিনটি মা
যেন সোনার প্রতিমা!বড় হয়ে তৃষা ছড়াবে
আলো শিক্ষার ,
বিচারক হয়ে তৃণামনি
করবে বিচার।
বৈমানিক হয়ে তূর্ণামনি
জয় করবে নীলিমা!
আমার তিনটি মা
যেন সোনার প্রতিমা!…আধাঁর চিরে আসবে তৃষা
হবে অরুণিমা,
চাঁদের শীতল পরশ বোলাবে
মেঝো চন্দ্রিমা!
স্নেহের শাসন করেই যাবে
ছোট্ট রানী মা!
আমার তিনটি মা
যেন সোনার প্রতিমা!
তারা অনন্যা
তাদের নেইকো উপমা!..
গান শেষ হবার পর কবীরের বোন নাজমা পারভীন কেঁদেই ফেলেছেন। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলেছেন
-তোমার গানের প্রতিটি কথা যেন সত্যি হয় ভাই। একদিন আমরা থাকবো না। অনুপ্রেরণা সরূপ রয়ে যাবে তোমার লিখা এই গান।
তারপর কোমল পিঠা কাটা হলো। আলোকচিত্র তোলা হলো ইয়াসিকা ক্যামেরায়।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তিন ভাগনী বাবা, মা ও মামার কোলে বসে জগলুর সাথে আডা উৎসবে মেতে উঠলো। ছোট্ট তূর্ণা মনি মায়ের কোলে বসেই বললো
-আমি ডগলু মামাকে গান থোনাপো
ওরা বাবা বললো
-গাও মা গাও, তোমার মামাকে একটি গান শুনিয়ে দাও…
তূর্ণামনি গান গাইতে লাগলো…
মোর ভবনালে কী হাওয়া মাথালো
দোলে মন দোলে অকালন হনষে
সবাই হাসি দিলে সে লজ্জা পেয়ে চমৎকার হাসিটা হাত দিয়ে ঢেকে মায়ের আঁচলে মুখ লুকালো।
বাবার কোলে বসে তূণামনি বললো আমি একটি ছবি একে জগলু মামাকে দেখাবো
জগলুঃ ওরে বাবা! তুমি ছবিও আঁকতে পারো
তৃণাঃ হুম, পারি তো মামা। আমাকে একটি কাগজ দাও মা।
ওর মা ওকে কাগজ ও অঙ্কনী দিয়ে মেঝেতে বসিয়ে দিলো। সে মাথা নুইয়ে মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকতে লাগলো।
একটু পর নাজমা আপা জগলুকে জিজ্ঞেস করলো
-সকালে প্রাতরাশে কি খাবে ভাই?
জগলুঃ আমি সকালের খাবার খাবো যমুনা নদীর তীরে ভূঞাপুর খেয়াঘাটে।
কাদেরঃ তাহলে তো ফজরের আজানের পর পরই রওয়ানা দিতে হবে!
নাজমাঃ আর একটু পরে যাও ভাই।
জগলুঃ আপা দরকার হলে এখনই আবার আরেকবার খাওয়ান। কিন্তু সকালে খাওয়ার সময় পাবো না। আমার রাজশাহী গিয়ে ছাত্রী পড়াতে হবে।
কবীরঃ আপা, ও সকালে খাবে না। আমরা তোমাদের ডাকবোও না। খুব ভোরে চলে যাবো। আমরা এখনই শুয়ে পড়বো। তোমারা যাও, শুভ রাত দুলাভাই।
কাদেরঃ শুভ রাত
ওরা সবাই চলে গেলে তৃণা ছবি এনে বলে
-এই যে জগলু মামা, আমার ছবিটি দেখো।
জগলু ছবিটি হাতে নিয়ে দেখে বলে
-খুব সুন্দর হয়েছে মা মনি
তৃণা এক দৌড়ে ছবিটি ভিতরে চলে গেলো।
১০ম পর্বঃ আমার তিনটি মা যেন সোনার প্রতিমা
উপন্যাসঃ অতল জলে জলাঞ্জলী
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ ভিলা, উত্তরখান, ঢাকা।