বৈশ্বিক গমের বাজারে আবারও শঙ্কার ছায়া

প্রকাশিত: এপ্রিল ৩, ২০২৩; সময়: ১০:১৪ am | 
খবর > অর্থনীতি

পদ্মাটাইমস ডেস্ক :  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে গত এক বছর ধরে গমের বাজারে বিরাজ করছে অস্থিরতা। এর মধ্যে বাজারে কিছুটা স্বস্তি আসতে না আসতে আবারও দেখা দিয়েছে সরবরাহ সংকট।

বড় বড় রফতানিকারক কোম্পানি রাশিয়া থেকে আর গম আমদানি করবে না বলে জানিয়ে দেয়ায় সামনের দিনগুলোতে খাদ্যশস্য গমের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি বার্তাসংস্থা ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রফতানিকারক কোম্পানি কারগিল ও ভিটেরা রাশিয়া থেকে আর গম রফতানি করবে না বলে জানিয়েছে। এর পাশাপাশি আর্চার ডেনিয়েলস মিডল্যান্ড করপোরেশন জানিয়েছে, তারাও রাশিয়াতে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন।

এর আগে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হাজারখানেক পশ্চিমা কোম্পানি রাশিয়া ছেড়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এসে খাদ্য রফতানির সঙ্গে সম্পর্কিত কোম্পানিগুলো রাশিয়া ছাড়ায় বিশ্ববাজারে বড় রকমের সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কেন রাশিয়া ছাড়ছে খাদ্যপণ্য রফতানিকারকরা?
গত বছর ডিসেম্বরে কারগিল ও ভিটেরার মতো কোম্পানির সম্পত্তি একরকমের বাজেয়াপ্ত করে রাশিয়া। মূলত গম রফতানিতে পশ্চিমাদের হম্বিতম্বি কমাতে এ উদ্যোগ নিয়েছিল দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

পুতিন নিজের দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ও রফতানিতে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর ওপরে নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। বিশেষ করে সরকারি ভর্তুকি পাওয়া কোম্পানিগুলোকে বেশি সুবিধা দেয়া, নিজেদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি বাজারে আধিপত্য বজায় রাখা থেকে শুরু করে নানামুখী সিদ্ধান্তে বিদেশি রফতানিকারক কোম্পানিগুলো রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ ব্যাপারে বিদেশি কোম্পানিগুলো বলছে, রাশিয়াই তাদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করছে। আগামী মে মাস থেকে নতুন মৌসুমে গম রফতানি শুরু হবে; অথচ এখনো নানা ধরনের কাগুজে ঝামেলায় প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে পারছে না বিদেশি কোম্পানিগুলো।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়েছে রাশিয়া। মূলত এসব কোম্পানির হাত ধরেই বিশ্ববাজারে গম রফতানিতে রাশিয়া হয়ে ওঠে একচ্ছত্র অধিপতি। দেশটির গমের দামকে বেঞ্চমার্ক ধরে এত দিন বিশ্ববাজারে গমের দাম ঠিক হতো।

সম্প্রতি ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের ৪৩.৫ শতাংশ গম রফতানি করে রাশিয়া। রাশিয়া থেকে বড় বড় কোম্পানিগুলো চলে যেতে বাধ্য হলে বৈশ্বিক গমের বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা বড় রকমের হুমকির মুখে পড়বে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে পশ্চিমারা বলছেন, রাশিয়া নিজেদের একটি পয়সাও পশ্চিমাদের হাতে দিতে চাচ্ছে না। মূলত যুদ্ধ চালানোর জন্য এখন রাশিয়ার দরকার বেজায় অর্থ। এ অর্থের জোগান দিতে রাশিয়া নিজেদের কোম্পানিগুলোকে গম রফতানির কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। এতে করে গমের বাজারে রাশিয়া যেভাবে স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারবে, একইভাবে সব টাকা নিজেদের পকেটভর্তি করে যুদ্ধও চালিয়ে নিতে পারবে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোকে রাশিয়া গমের মাধ্যমেই নিজেদের হাতে রাখতে পারবে। খাদ্যবাণিজ্যকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব খাটাতে চাচ্ছে রাশিয়া – এমনটাই অভিযোগ পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর।

পণ্য ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষক ম্যাট অ্যামারম্যান বলেন, রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে রাশিয়া যত নাক গলাবে, ততই স্বেচ্ছাচারিতা খাটাবে; তাতে বৈশ্বিক গমের বাজার তত বেশি অস্থির হয়ে উঠবে। সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছে। মাঝখানে মস্কো খামাখা সরবরাহ ব্যবস্থায় বাগড়া দিচ্ছে।

যদিও রাশিয়ার কৃষিবিভাগ থেকে বলা হয়েছে, এটি কেবল প্রতিষ্ঠান বদল। রফতানি যেভাবে চলছে একইভাবে চলতে থাকবে। তবে পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাশিয়া নিজেদের গমকে যুদ্ধের রসদ ও অর্থ জোগানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। রাশিয়া মূলত জি-টু-জি (রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের) চুক্তির দিকে বেশি জোর দিচ্ছে। এতে করে বিশ্ব মেরূকরণের পরিমাণ আরও বাড়বে, সংকট ঘনীভূত হবে ও খাদ্য রফতানিতে সমতা ব্যাহত হবে।

এদিকে রাশিয়ান কোম্পানি ওজেডকে জানিয়েছে, এরই মধ্যে তুরস্কের সঙ্গে গম নিয়ে বেশ কয়েকটি চুক্তি হয়েছে। এখন থেকে এমনভাবে ব্যবসা হবে, যাতে করে সামনের দিনগুলোতে সরবরাহের জন্য বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে না হয়।

বিশ্ববাজারে কী প্রভাব পড়বে?
ভিটেরা ও কারগিলের মতো কোম্পানিগুলো গত মৌসুমেও রাশিয়া থেকে ১৪ শতাংশ গম রফতানি করেছে। রাশিয়ার খামখেয়ালিতে ত্যক্ত হয়ে দুটি কোম্পানিই আপাতত নিজেদের নতুন ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা করছে। যদিও কারগিল চলতি বছর মে মাসে গম রফতানি করবে বলে জানিয়েছে। তবে জুন থেকে তারা আর রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করবে না বলে নিশ্চিত করেছে।

এছাড়া অনেক রাশিয়ান কোম্পানি রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে ভরসা পাচ্ছে না। মূলত পশ্চিমাদের বদৌলতে রাশিয়ার ওপর হাজারখানেক নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারে লোকসানের আশঙ্কা করছে। তবে মস্কোর রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রোজাগ্রোলিজিং জানিয়েছে, তারা গম রফতানির জন্য নিজেরাই ৬০টি বাল্ক শিপ নির্মাণ করবে। তবে এ নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় লাগবে কম করে হলেও এক বছর। এ অবস্থায় বৈশ্বিক গমের বাজারে চলতি বছর ও আগামী বছর আবারও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দেশের বাইরে গম রফতানি করা ছাড়াও রাশিয়ার এমন সিদ্ধান্তে ভুক্তভোগী হবে খোদ দেশটির কৃষক সম্প্রদায়। বাইরের কোম্পানিগুলো চলে যাওয়ায় এবং দেশি কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে একযোগে দাম ঠিক করলে বাজার থেকে প্রতিযোগিতা উঠে যাবে; শুরু হবে দাম নিয়ে বৈষম্য, মুনাফালোভী আচরণ ও যাচ্ছেতাই স্বেচ্ছাচারিতা। এছাড়া যে পন্থায় রাশিয়া নিজেদের রফতানি বাণিজ্য চালাচ্ছে, তাতে করে ভবিষ্যতে দেশটি গমের বাজারে মূল্যনির্ধারণের বেঞ্চমার্ক ট্যাগ হারাতে পারে বলে ধারণা করছেন অ্যাগ রিসোর্সের পরামর্শক ড্যান বোস।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) হিসাব মতে কমেছে গমের দাম। গত মাসে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে ২ শতাংশ। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে ৩৪ শতাংশ; আর ভুট্টার ১৩ শতাংশ।

বাংলাদেশে গমের বাজার
আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমে এলেও এর প্রভাব এখনো পড়েনি দেশের বাজারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরপরই বাজারের অধিকাংশ গম আমদানি হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে।

দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বর্তমানে ভালো মানের গম বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। অন্যদিকে মাঝারি ধাঁচের গমের দাম মণপ্রতি ২ হাজার টাকার মতো। এতে করে দেশের পাইকারি বাজারেই গমের দাম পড়ছে কেজিপ্রতি ৫১ টাকা।

বাংলাদেশ বর্তমানে বেশিরভাগ গম ভারত থেকে আমদানি করায় রাশিয়ার সরবরাহব্যবস্থার তাৎক্ষণিক প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না বলে মতামত সংশ্লিষ্টদের। তবে বিশ্ববাজারে গমের দাম নিয়ে আবারও অস্থিরতা দেখা দিলে, দামের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক তারতম্য দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন ব্যবসা বিশ্লেষকরা।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন