প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়

প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২৩; সময়: ৫:৫১ pm | 
খবর > আঞ্চলিক

আদিবা বাসারাত তিমা : বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি বগুড়া মহাস্থানগড়। পূর্বে এর নাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর। ইতিহাস রচিত অতীত সভ্যতার লীলাভূমি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা খননে বেরিয়ে এসেছে প্রায় ২৩শ’ বছরের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন। পূর্ব ও উত্তর পাশে করতোয়া নদী, পশ্চিমে কালীদহ সাগরখ্যাত জলাশয় আর পশ্চিম-দক্ষিণে বারনসি খাল দিয়ে ঘেরা এলাকাটি এখন মহাস্থানগড় নামে পরিচিত।

এক সময় বগুড়া মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। ২০১৬ সালে এটি সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষনা হয়। ইতিহাসে এর পরিচয় এক প্রসিদ্ধ নগরী হিসেবে। পুণ্ড্রনগর নামে অভিহিত সেই নগরীটি তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে মৌর্য, সুঙ্গ, গুপ্ত, পাল, সেন প্রভৃতি বৌদ্ধ ও হিন্দু রাজবংশের রাজত্বের রাজধানী ও শাসনকেন্দ্র ছিল।

দেশের সর্বপ্রাচীন নগরী বা সমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদের নাম উঠলেই উচ্চারিত হয় পুণ্ড্রবর্ধনের নাম। এই জনপদের রাজধানীটি কালের বিবর্তনে প্রোথিত হয়েছে মহাস্থানগড়ের ভূগর্ভে। মহাস্থানগড় তাই বিশ্ব ঐতিহ্যে (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) স্থান পাওয়ার অপেক্ষায়। এজন্য গড় এলাকায় এখনো পুরোদমে চলছে উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ। সেই সঙ্গে দীর্ঘ বিরতির পর পুণ্ড্রনগরের শহরতলি ভাসুবিহারেও প্রত্নতাত্ত্বিক খনন জোরদার হয়।

আড়াই হাজার বছরের সভ্যতা নিয়ে মাটির নিচে নগরীটি চাপা পড়লেও তার দুর্গপ্রাচীর আর প্রবেশদ্বারের ধ্বংসাবশেষ এখনো দৃশ্যমান। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বেরিয়ে আসা নানা নিদর্শন পর্যটকদের বিভিন্ন ভাবে আকৃষ্ট করে থাকে।

একইভাবে বৌদ্ধ, হিন্দু আর মুসলমানদের তীর্থস্থান হিসেবেও বর্তমানের মহাস্থানগড়ে আসে হাজারো ভক্ত ও দর্শনার্থী। আর শুধু মহাস্থানগড়ই নয়, এর পার্শ্ববর্তী প্রায় পাঁচ বর্গমাইল এলাকায় প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য আর স্থাপত্য নিদর্শন ছড়িয়ে থাকায় সেসব স্থানও সমান আকর্ষণীয় সর্বসাধারণের কাছে।

বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলায় মহাস্থানগড়ের অবস্থান। সমতলভূমির চেয়ে ১৫ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু বলে এই এলাকাটি গড় (উঁচু স্থান) হিসেবে পরিচিত। প্রাচীরবেষ্টিত পাঁচ হাজার ফুট দীর্ঘ ও চার হাজার ৫০০ ফুট প্রশস্ত গড়ের ভেতরে রয়েছে নানা প্রত্ননিদর্শন।

এর মধ্যে রয়েছে পরশুরাম প্যালেস, জিয়ৎ কুণ্ড বা জীবন্ত কূপ, গোবিন্দ ভিটা, বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুণ্ডু, মুনির ঘোন, শিলা দেবীর ঘাট ও মহাস্থান মাজার ইত্যাদি। এছাড়াও নগরীর বাইরের প্রায় পাঁচ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে রয়েছে বেহুলার বাসর ঘর, খ্যাত গোকুল মেড়, ভীমের জাঙ্গাল, ভাসুবিহার, বিহার ধাপসহ নানা প্রত্নস্থল ও নিদর্শন।

পুণ্ড্রনগর থেকে মহাস্থান :
মহাস্থান নামটি এসেছে নানা কিংবদন্তি থেকে। এই জনপদের ইতিবৃত্ত নিয়ে রচিত ‘পুণ্ড্র’ গবেষণা গ্রন্থে অধ্যাপক মোস্তফা আলী এবং ‘ইতিকথা-পৌণ্ড্রবর্ধন’ গ্রন্থে অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান উল্লেখ করেছেন, মহাস্থান শব্দের আভিধানিক অর্থ বিখ্যাত জায়গা। স্থানটির নাম মহাস্থান হয়েছে বিখ্যাত স্নানের জায়গা থেকে। ‘করতোয়া মাহাত্ম্য’ কাব্যগ্রন্থে মহাস্থানকে বিষ্ণুর স্থায়ী আবাসস্থল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রতি ১২ বছর (এক যুগ) পর পৌষ নারায়ণী মেলায় হাজারো পুণ্যার্থী এখানে স্নানের জন্য সমবেত হন এবং প্রতিবছর চৈত্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে এখানে স্নান অনুষ্ঠিত হয়। তবে মুসলমানদের কাছে এটি ‘মস্তানগড়’ হিসেবে পরিচিত।

শাহ সুলতান মাহমুদ মাহীসওয়ার বলখী (র.) এই নগরী আক্রমণ করে ক্ষত্রিয় নৃপতি পরশুরামকে পরাজিত করে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর মাজার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয় এক ব্যক্তিকে নদী তীরবর্তী কিছু জমি দান করা হয়।

সেই দানপত্রের সনদে এই স্থানকে মহাস্থানগড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে কেউ কেউ বাংলাদেশের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহ মস্তানার নামানুসারে এই নামকরণ বলে মনে করেন। কারণ ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মজনু শাহ মস্তানা মহাস্থানকে তাঁর কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

বিভিন্ন কারণে মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন প্রত্নস্থল হিসেবে সারা দেশের পর্যটক এবং ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে বগুড়া মহাস্থানগড় একটি আকর্ষনীয় জায়গায় পরিণত হয়েছে।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন