ট্রেনে নিরাপত্তার অভাব, ঘটছে ধর্ষণ হত্যাকাণ্ড

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : অপরাধ রুখতে কিংবা অপরাধীদের ধরতে সিসিটিভি-ক্যামেরার গুরুত্ব অপরিসীম। এমনটা আমলে নিয়েই রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে সিসিটিভি স্থাপন করা হয়েছে। তবে সব স্টেশন এবং স্টেশন এলাকায় তা স্থাপনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। রেলে ৩৭৩টি যাত্রীবাহী ট্রেনের মধ্যে মাত্র ৫টিতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। মোট ট্রেনের মধ্যে ১০৭টি আন্তঃনগর এবং ৫০টি মালবাহী ট্রেন। অর্থাৎ প্রায় ৭৫ শতাংশ ট্রেনে সিসিটিভি নেই।
আবার ৫টি ট্রেনে সিসি ক্যামেরা থাকলেও তা এক প্রকার অকেজো। ৪৬৬টি স্টেশনের মধ্যে ৩৭ শতাংশ স্টেশনে সিসিটিভি-ক্যামেরার ব্যবস্থা আছে। এমন উদাসীনতার মধ্যে রেলপথ-ট্রেনে নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে হত্যাসহ চুরি-ডাকাতির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
১৬ জানুয়ারি ঢাকা থেকে লালমনিরহাটের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেনে ভুলবশত উঠে পড়া এক শিশুকে কেবিনে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট আক্কাস গাজীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে ধর্ষণ শেষে এক কিশোরীকে হত্যা করে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় একটি পরিত্যক্ত ট্রেনের বগির ভেতরে আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
একই বছরের ২৮ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে আহত করা হয়। এদিকে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি রাতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে চলন্ত সুরমা মেইল ট্রেনে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পরিত্যক্ত বগিতে এক তরুণীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১১ জুলাই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে টয়লেটে নিয়ে এক শিশুকে ধর্ষণ করে অপরাধীরা।
জানা যায়, এক যুগে রেল স্টেশন, ট্রেন এবং পরিত্যক্ত বগিতে ১৪ জন ধর্ষণ ও ধর্ষণ শেষে হত্যার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ও রেলওয়ে পুলিশের প্রধান দিদার আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, রেলপথে যাত্রী নিরাপত্তা এবং রেলওয়ে সম্পদ রক্ষায় রেলওয়ে পুলিশ, আরএনবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সর্বদা সতর্কাবস্থায় থাকেন। তবে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার রেলপথে ট্রেনযাত্রী এবং মালামাল সুরক্ষায় আরও সদস্য প্রয়োজন।
আমরা অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করে কোটে পাঠাচ্ছি-জেল, সাজাও হচ্ছে। রেলপথে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে দিনরাত মাঠে থাকছে রেলওয়ে পুলিশ। ট্রেন বা স্টেশন সিসিটিভি স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই। সব স্টেশন এবং ট্রেনে সিসিটিভি-ক্যামেরা স্থাপন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সম্প্রতি ট্রেনে ধর্ষণের ঘটনায় তাৎক্ষণিক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রেলপথ, স্টেশনে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার রেলপথে ৩৭৩টি ট্রেন চলাচল করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের মাঠ পর্যায়ে থাকা একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কিছু লোকাল, মেইল ট্রেন রাতে অন্ধকার অবস্থায় চলে। অর্থাৎ ট্রেনগুলোর অধিকাংশ বগিতে লাইট থাকে না। দরজা-জানালা সর্বদাই খোলা থাকে। এমনকি টয়লেটেও বাতি থাকে না। অপরদিকে ১০৭টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে মাত্র ৫টি ট্রেনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন হয়েছে।
তবে সেগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে না। অধিকাংশ ক্যামেরাই বিকল। আবার ক্যামেরা চালু থাকলেও ভিডিও পাওয়া যায় না। এসব সিসি ক্যামেরা স্থাপনের বয়স মাত্র কয়েক মাস হলো। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রেললাইন কেটে ফেলা, ট্রেনে আগুন দেওয়াসহ নানা ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
ওই অবস্থায় ট্রেনের যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেললাইনে পাহারা বসানো এবং ট্রেনে আগুন লাগানো দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করতে ট্রেনের ভেতরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু মাত্র ৫ শতাংশ ট্রেন এমন ব্যবস্থা রাখলেও সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি-অডিও সাউন্ড সেন্ট্রাল সিস্টেমে ধারণের এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পর্যায়ক্রমে সবকটি ট্রেনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। শুরুতে কিছু অসংগতি থাকলেও দ্রুত সময়ের মধ্যেই তা পূর্ণাঙ্গ রূপ নেবে। ট্রেনের মধ্যেই মনিটর স্থাপন করা হবে। ক্যামেরাগুলো থেকে যেন ডেটা নেওয়া যায়, সেই পদ্ধতির দিকে যাওয়া হচ্ছে।
একই সঙ্গে সবকটি স্টেশনেও সিসি ক্যামেরা স্থাপন নিশ্চিত করা হবে। রেলওয়ে অপারেশন এবং পরিবহণ দপ্তর সূত্র বলছে, বিভিন্ন ট্রেনের কোচ প্রায় পরিবর্তন করা হয়। যে জন্য সিসি ক্যামেরা-সংযুক্ত তার বিচ্ছিন্ন করতে হয়, এতে ক্যামেরার কার্যকারিতা থাকছে না। বিদেশ থেকে আধুনিক কোচ আনা হচ্ছে। ওইসব কোচ তৈরির সময়ই নীতিনির্ধারকরা যদি কোচগুলোয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিসি ক্যামেরা স্থাপন নিশ্চিত করত, তাহলে এমন সমস্যা হতো না।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যাত্রী সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, এখনো অধিকাংশ স্টেশন এবং ট্রেনে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। দেশ যেখানে বুলেট ট্রেন নামানোর দিকে এগোচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ স্টেশন এবং ট্রেনে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যাত্রীদের সাহায্যের জন্য ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন খোলা হোক, যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রতিটি ট্রেনেই।