রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রমশ কমছে পশু-পাখি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪; সময়: ১২:৫৪ pm | 
খবর > বিশেষ সংবাদ

নিজস্ব প্রতিবদেক, রাবি : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাস। এখানে সারাবছর দেখা মেলে অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী। এছাড়াও শীতের শুরুতে আগমন ঘটে বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির। পশু-পাখির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় এই ক্যাম্পাস।

বিলুপ্তপ্রায় জলমুরগি, জলপিপি ও জলময়ূর ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায় এখানে। হাঁস জাতীয় প্রাণী এখানে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ল্যাঞ্জাহাঁস, খুন্তেহাঁস, ভূতিহাঁস, বড় সরালি এসবের বাইরেও ঘুঘু, চড়ুই, কাক, কোকিল, দোয়েল, শ্যামা, ফিঙে, চিল ও টিয়ে ইত্যাদি প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে কাঠবিড়ালি, শেয়াল, বেজি, বনবিড়াল, সজারু,গন্ধগকুল, সাপ,বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি।

একসময় এসব প্রাণী ছাড়াও শীতকালে প্রচুর সংখ্যক পাখির আগমন ঘটত। কিন্তু বর্তমানে এত বেশি অতিথি পাখির দেখা মিলছে না। তাছাড়াও অন্যান্য পশু-পাখির উপস্থিতি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

বর্তমানে ক্যাম্পাসে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য গাছপালা কাটা হচ্ছে এবং জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে যার ফলে ক্যাম্পাস পশু-পাখির বসবাসের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ভবন নির্মাণ, উচ্চশব্দ, জলাশয়ে, অনিয়ন্ত্রিত মাছ শিকারের ফলে পশু-পাখিদের অনূকূল পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পশু পাখির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা বলেন, “আমরা চলাফেরা করতে আশেপাশে তাকালেই আমাদের সাথে একসাথে বসবাস করছে এমন পশুপাখি দেখতে পাই। কিন্তু আমরা বর্তমানে সাধারণত তা দেখি না।”

তার ভাষ্যমতে পশুপাখি গণনার কাজ বা ওয়াইল্ড এনিমেল নিয়ে কোন গবেষণার কাজ এ পর্যন্ত হয় নি। এই ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যে বাউন্ডারি আছে তার পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্বও প্রশাসনের চলে আসে।

পরিবেশ সংরক্ষণ যদি সঠিকভাবে করে তারা তাহলে পরিবেশের উপাদান গুলো ঠিক থাকবে। কোন পশু পাখিকে মারা বা ধরা প্রশাসনে কাজের মধ্যে পড়ে না।”

তিনি আরও বলেন, পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিরা কোন উন্নয়ন করার আগে সে পরিবেশের বায়ো ডাইভারসিটি নিয়ে সমীক্ষা চালায় এবং সে ফলাফল অনুযায়ী উন্নয়ন কাজে অগ্রসর করে। পাখি আসা নিয়ে তিনি বলেছেন যতদিন পুকুর ভরাট,পুকুরে লিজ দেওয়া এবং মাছুয়া থাকবে ততদিন তারা তাদের নিরাপত্তা পাবে না।তাদের আনাগোনা কম হয়ে যাবে।

ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষিত কোন বন বা জঙ্গল জিনোম রাখতে চেলেও তা পারা যাচ্ছে না। যেমন রবীন্দ্র ভবন ও সিরাজি ভবনের উত্তরে জীববৈচিত্র সংরক্ষণে জঙ্গল জিনোম প্রকল্প কার্যক্রমের আওতায় সংরক্ষিত রেখেছিল।

কিন্তু প্রশাসনের রদ বদলে ২০১৬-১৭ সালের পর এ বিষয়ে নেতিবাচক চিন্তা চেতনার ফলে প্রশাসন তার সংরক্ষিত রাখতে দেয়নি। পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “যে যা অবস্থান থেকে প্রত্যেক জীবের প্রতি একটু সহনশীলতার সহমর্মিতার আচরণ করি।’

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ক্যাম্পাসের কুকুর দেখাশোনা করছেন টিএসসির কর্মচারী মো: গাজিউল ইসলাম। খাওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে তার বেতনের বড় একটি অংশ যায় কুকুরদের খাদ্যের যোগান দিতে।

গাজীউলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৬ বছর আগে ২০০৮ সালে নিজের অর্থায়নের মানবিক জায়গা থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পশুপাখির জন্য কাজ করা শুরু করেন। তিনি তার আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যয় করেন পশুপাখির পেছনে। তার প্রতিদিন সকলের একটা অংশ কাটে পশুপাখির সঙ্গে।

কুকুর ও বিড়ালের ভাষাও বুঝতে বাকি নেই তার। প্রথমে নিজ অর্থায়নে শুরু করলেও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়ান।

তিনি আরও বলেন যে হলের ডাইনিং-ক্যান্টিন খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে বঞ্চিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপাখিগুলো। কারণ হলের ডাইনিং-ক্যান্টিন মালিকরা উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো পশুপাখিকে না দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেন ফলে উচ্ছিষ্ট খাবার থেকেও বঞ্চিত হয় এসব পশুপাখি।

ফাইন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী অর্পিতা হোসেন জানান, ” ক্যাম্পাসের ভিতরে পশুপাখি বেশি নিরাপদ বাহিরের তুলনায়। ভিতরের মানুষ পশু পাখির ওপর বেশ যত্নশীল হয়েছে।

যেমন- টুকিটাকি এক দোকানদার একটি কুকুর এবং তার তিনটা বাচ্চাকে নিজের দোকানে আশ্রয় দিয়েছে । এছাড়া ক্যাম্পাসে কুকুরের বাচ্চা মৃত্যুর হার আগের চেয়ে কমেছে।”

তিনি আরও বলেছেন, শীতকালে পাখির সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কম দেখা যাচ্ছে ক্যাম্পাসে । এক বছর আগেও বিভিন্ন জায়গায় আনাগোনা ছিল সেই তুলনায় বর্তমানে তেমন কোন পাখি দেখা যায় না।

ক্যাম্পাসে কোন স্বেচ্ছাসেবক উদ্ধার কাজ হয় কিনা সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, “বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক উদ্ধার প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা নিজ উদ্যোগে পশু পাখিকে সেবা দিয়ে থাকে।

ক্যাম্পাসের প্রাণী রক্ষায় বেশকিছু সেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। এমন দুটি সংগঠন হচ্ছে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অ্যানিমাল ওয়ালফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এবং ইকোলজি স্নেক রেসকিউ ফেডারেশন।

ইকোলজি স্নেক রেসকিউ ফেডারেশন সদস্য প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সামিত বিন রহমান বলেন, ‘‘শেখ হাসিনা হল যেখানে রয়েছে সেখানে একটা পুকুরের অর্ধেক ভরাট করা হয়েছে। সেখানে ১৬৬ টি প্রজাতির পাখির বসাবস ছিল।

সেই সংখ্যাটা এখন ৫০ এর নীচে নেমে গেছে। ওখানে বাইরে থেকে লোক এসেও পাখি শিকার করত। জলতিথি, জলময়ূর নামের পাখি একসময় রাবি ক্যাম্পাসে বিচরণ করত। ওদেরকে বিরক্ত করার কারনে এখন ক্যাম্পাসে খুব একটা দেখা যায় না।’’

এছাড়াও তিনি বলেন বধ্যভুমির আশেপাশের পুকুর গুলোতে আগে অনেক পাখি নামত তবে বর্তমানে পুকুরগুলো লিজ দেওয়ায় মাছ চাষিরা পুকুরের উপরে দড়ি টানিয়ে দেয় ফলে পুকুরে পাখি নামতে পারেনা।

ভেটেনারি বিভাগের শিক্ষার্থী মো: আবু নায়েম তন্ময় কাজ করছেন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এর সদস্য হিসেবে।

তিনি তার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন অনেক সময় বাচ্চা কুকুর গুলো ঢাকনা বিহীন ড্রেনে পরে যায়, যেগুলো উদ্ধার করা কষ্টকর। গ্রীষ্মের সময় কুকুরদের গায়ে ম্যাগট পোকা হয়ে যায়। তবে শীতকালে এধরনের রোগ দেখা যায় না।

তিনি আরও বলেন যে, ‘‘আমরা যখন ক্যাম্পাসের ভেতর প্রথম কাজ শুরু করি তখন অবস্থা অনেক খারাপ ছিলো তবে এখন অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। ক্যাম্পাসে যারা আছে তারা বেশিরভাগই পশু প্রেমী। সবমিলিয়ে বলা যায় যে ক্যাম্পাসে পশু-পাখি বেশ ভালোই আছে।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের রহমাতুন্নেসা হলের পাশের পুকুর, তুঁত বাগান সংলগ্ন পুকুর, পশ্চিম পাড়া শিক্ষক কোয়াটারের ভেতরে দুটি পুকুর ও শামসুজ্জোহা হলের পাশের পুকুর এবং কৃষি অনুষদ সংলগ্ন জলাশয় গুলোতে পরিযায়ী পাখিদের দেখা যায়।

 

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন