স্যালাইন দেওয়ার পর ২ প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় রাজশাহীতে তোলপাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীতে স্যালাইন দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের আগে সম্প্রতি রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের এই স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। স্যালাইন দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়া দুই নারী এখনও ওই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি রয়েছেন।
প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে মারা যাওয়া নারীদের স্বজনদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে ওই স্যালাইন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে বিষয়টি জেলার সিভিল সার্জন কিংবা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে জানায়নি বেসরকারী এই হাসপাতালটির কর্তৃপক্ষ।
দুই সপ্তাহ আগে এ ঘটনা ঘটলে শুক্রবার তা প্রকাশ পায়। এর পর বিষয়টি নিয়ে তোড়পাড় সৃষ্টি হয় স্বাস্থ্য বিভাগে। শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আনোয়ারুল কবির বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগকে ঘটনাটি না জানিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্যায় করেছে। এটা খুবই স্পর্শকাতর ব্যাপার। আমাদের জানানো উচিত ছিল। আমরা জানতে পারলে আমাদের মতো করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তারা কেন আমাদের কাছে এটা লুকিয়েছে, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি শোনার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তারা দুইজন মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করেছে। সেই সঙ্গে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। শনিবার তারা তদন্ত প্রতিবেদন দিতে চেয়েছে। সেটি পাওয়ার পর আমরা বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিব।’
হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে,
সম্প্রতি সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার আগে আইভি স্যালাইন দেওয়ার পর চারজন নারীর একই রকম শারীরীক সমস্যা শুরু হয়। অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে তাদের শারীরীক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তাদের কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। হার্টে ব্লক দেখা দেয়। এতে দুইজন নারীর মৃত্যু হয়। বর্তমানে দুজন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তবে চিকিৎসাধীন ওই দুই নারীদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সাংবাদিকরা হাসপাতালটির পরিচালক ডা. সানাউল হক মিয়াকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে হাসপাতালের ইনচার্জ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে কমিটি হয়েছে। তারা কাজ করছেন।’
মারা যাওয়া নারীদের মধ্যে একজন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আনুলিয়া গ্রামের আফজাল হোসেনের স্ত্রী আসমা খাতুন (৩৮)। মারা যাওয়া আসমা খাতুন একটি বেসরকারী সংস্থার রাজশাহীর পবা উপজেলা শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন।
মারা যাওয়া অপর নারীর বাড়ি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলায়। তবে ওই নারীর স্বামী তার এবং স্ত্রীর নাম-পরিচয় জানাতে চাননি। তিনি বলেছেন, ‘ভাগ্যে মৃত্যু ছিল, হয়ে গেছে। এসব বলে আর লাভ নাই।’
মৃত্যু আসমা খাতুনের স্বামী আফজাল হোসেন জানান, আসমা প্রথমবার গর্ভধারণ করেছিলেন। একবছর ধরে প্রতিমাসেই তিনি ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. সুলতানা নাজনীন রিতার কাছে চেকআপ করাতেন। সন্তান প্রসবের সময় হলে গত ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় স্ত্রীকে হাসপাতালটিতে ভর্তি করেন। ভর্তির পর তার স্ত্রীকে একটি স্যালাইন দেওয়া হয়। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার স্ত্রী পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। শিশুটি সুস্থ্যভাবেই জন্মে। তবে ধীরে ধীরে তার স্ত্রীর শারীরীক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, রাত ৪টার দিকে চিকিৎসকেরা আমাকে জানায় আসমার দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে পড়েছে। হার্টের কার্যক্ষমতাও কমে গেছে। আফজাল হোসেন তখন বলেন, গর্ভধারণের পুরোটা সময়ই তিনি মাসে মাসে স্ত্রীকে চেকআপ করিয়েছেন। তখন কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। হঠাৎ করে এখন এত সমস্যা কেন? চিকিৎসকেরা তখন জানান, এটা স্যালাইনের পার্শপ্রতিক্রিয়া।
আফজাল হোসেন বলেন, রাত সোয়া ৪টার দিকে ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব লোক ও অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে আসমাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ মিনিট পর আসমা মারা যান।
আফজাল জানান, আসমার মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মোটা টাকার বিনিময়ে আপস করার প্রস্তাব দেয়। তবে তিনি আপস করতে চান না। তিনি স্ত্রীর অপমৃত্যুর বিচার চান। এ নিয়ে তিনি মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুলতানা নাজনীনী রিতার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে ঘটনা তদন্তে গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান হাসপাতালটির সার্জারী বিভাগের প্রধান ডা. আবু বকর সিদ্দিকী বলেন, ‘স্যালাইন দেওয়ার পর কয়েকজন রোগীর ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। ওই স্যালাইনটা আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মো. ফারুক বলেন, ‘শুক্রবাব ঘটনাটি শুনলাম, সেটাও অন্য মাধ্যমে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছু জানায়নি। ইতোমধ্যে আমরা সব তথ্য চেয়েছি হাসপাতাল থেকে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। হাসপাতালের গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’